হৈচৈ ছোটদের গল্পে মেরী খাতুন

বামন

বিয়ের পর এবাড়িতে আসার পরেই শ্বশুর মহাশয় এক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। দোষ গিয়ে পড়লো ওর ওপর, ও নাকি অপয়া। শাশুড়ি সকাল সন্ধ্যা এ নিয়ে খোঁটা দিলে সৌমীর দুঃখ হত। কিন্তু ওর স্বামী  শুভংকর ওর মন ভালো করতে ওকে বোঝাতো বিজ্ঞানের উপমা দিয়ে যে, সবটাই মনের কুসংস্কার ছাড়া কিছুই না। স্বামীর এ কথা শোনার পর সৌমীকে অপয়া বললেও ও  কিছু মনে করতো না।

এরপর সৌমী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিলে শাশুড়ির গালমন্দ শুরু হয়ে যায়। অপয়া বউ হলে যা হয়, এমন বউ ঘরে একটা প্রদীপ জন্ম দিল না। শুধু শুভংকর মেয়ের জন্ম হয়েছে বলে খুব খুশি হয়। ও ওর মাকে বলে মেয়ে তো ঘরের লক্ষ্মী মা? মেয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে।ফুটফুটে সুন্দর পরীর মত দেখতে হয়েছে বলে, শুভংকর ওর নাম রাখে রূপসা। রূপসার জন্মের একবছর বেশ আনন্দে কেটে গেল। তারপর ওরা দেখতে লাগলো রূপসা অন্য সাধারণ বাচ্চাদের মত বড় হচ্ছে না, একই রকম রয়েছে। রূপসার বৃদ্ধি ঠিকমত না হাওয়ায় সৌমী আর শুভংকর মিলে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার প্রথমে দেখে রক্ত এবং হরমোন টেস্ট করতে বলে, এবং পরের সপ্তাহে রিপোর্ট নিয়ে যোগাযোগ করতে বলে।

এক সপ্তাহের পর যখন রূপসার বাবা-মা ডাক্তারের কাছে যায়, তখন ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলেন যে, রূপসা আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মত নয়। ও বামন। একথা শোনার পর সৌমী আর শুভংকর খুব ভেঙে পরে। শুভংকর আগের মত রূপসাকে আর কোলে নেয় না, আদর করে না, রূপসার সাথে খেলে না। দিন দিন যেন মেয়েকে আর সহ্য করতে পারছে না শুভংকর। শাশুড়ির অত্যাচারও চরমে ওঠে। শুভংকরও আস্তে আস্তে সৌমীর প্রতি দুর্ব্যবহার শুরু করে। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে শুভংকর। দুহাতে মুখ ঢেকে মা….মা বলে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে সৌমী। তবুও সব কিছুই সহ্য করে স্বামী, শাশুড়ির মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করে সৌমী। কিন্তু সব সম্পর্ক কি সুখের হয়? একদিন হঠাৎ শুভংকর অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে ঢোকে। রুপসাকে নিয়ে সৌমী অপমানে,দুঃখে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

মা-মেয়ে দুজনে চেনা পরিচিতের জগৎ ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। মা-আর মেয়ে একে অপরের অবলম্বন হয়ে জীবন শুরু করে। একটা সেলাই স্কুলে কাজ পাই সৌমী।হাড়ভাঙা পরিশ্রম শুরু করে মেয়েকে মানুষ করার জন্য।
এদিকে যত বয়স হয় রূপসা তত ঘরে বাইরের বিদ্রুপ,ঠাট্টার স্বীকার হয়। রূপসাকে দেখে সবাই হাসি মজা করতে থাকে।
সৌমী রূপসাকে একটা স্কুলে ভর্তি করে। কিন্তু সেখানেও ঠাট্টা, বিদ্রুপ, ওকে নিয়ে কৌতুক ওর পিছু ছাড়ে না। রূপসা স্কুল যেতে চায় না। মাকে বলে ও আর স্কুল যাবে না, পড়াশোনা করবে না। সৌমী তখন রূপসাকে বোঝায়। বলে, লোকের বিদ্রুপ উপেক্ষা করে পড়াশোনা করতে হবে, নিজের মনের জোর বাড়াতে হবে। রূপসা মায়ের কথা শুনে অন্যের ঠাট্টা,বিদ্রুপকে নিজের শক্তিতে পরিণত করে।

যখন মানুষ সবদিক থেকে সবার কাছে অপমানিত,ছোট হতে থাকে, তখন সে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে চায়। রূপসাও পড়াশোনাকে আঁকড়ে ধরে। অপমান, চোখের জল এক সময় শেষ হয়ে মানুষের শক্তিতে পরিণত হয়।
মেধাবী রূপসা শারীরিক গঠন উপেক্ষা করে সমস্ত পরীক্ষায় ভালো ফল করে।

পড়াশোনা শেষ করে রূপসা কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসে এবং পাশও করে।
রূপসার নতুন জীবন শুরু হয় কলেজের অধ্যাপিকা হয়ে। নতুন ম্যাডাম বামন দেখে কলেজের ছাত্রছাত্রী এমন কি কলিগরা পর্যন্ত ঠাট্টা করতে থাকে, সামনে পিছনে হাসাহাসি করে। রূপসার খুব মন খারাপ হয়। বাড়িতে  মায়ের কোলে মাথা রেখে ভেঙে পড়ে রূপসা। সৌমী মেয়েকে বলে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।
রূপসার মিষ্টি ব্যবহার আর পড়ানোর দক্ষতায় অল্পদিনেই সবার প্রিয় হয়ে ওঠে।

জীবন অনেক বড়, তাই শারীরিক গঠন বাঁধা হলেও,  মনের জোর আর মায়ের ভরসা ও আশীর্বাদের হাত মাথার উপর থাকলে মানুষ সব বাঁধা জয় করতে পারবে।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *