গদ্য বোলো না -তে (রূপং দেহি, জয়ং দেহি) মন্দিরা ঘোষ

ভূমিশরীর

এই মাস ভাদুফুল আর ভাদুগানের মাস। এ মাস ভদ্রাবতীর। প্রেমের, আবার বিনাশের ও।
এই মাস শিউলির । শিউলিও তো পুড়ে ছিল অভিমানে। তাই তো সূর্যের আড়ালে ,তাই তো রোদে সে নত আর অভিমানী।
এই মাস তর্পণেরও। এ মাস আগমনীর।এ ঋতু আবাহনের যেমন ,তেমন বিসর্জনেরও।
ধুনোরং আকাশে তাই নিঃস্বতার ডানা ম্যালে বর্ষার মেঘ।ফিরে যায় বিরহী যক্ষের দ্বারে।
শরতের গায়ে তখন আকাশ পাড়ের শাড়ি।সবুজের খোলে সাদা কাশের ঠাস বুনোট।ঘাসে ঘাসে আলতা শিশিরের ছাপ। রাঙা পায়ের করুণা মাখছে লাল ধুলোর ভোর।
বর্ষাফড়িং উড়ে উড়ে বৃষ্টিফুলের সাথে লুকোচুরি খেলা।রোদসাঁতারে ব্যস্ত পুকুরঘাট, মাঝপুকুরে হাঁস আর পানকৌড়ির মাতামাতি। ওরা যেন টের পেয়েছে আজ ভাদ্র সংক্রান্তি! আজ পিতৃপক্ষের শেষে শুরু হবে দেবীপক্ষের সূচনা।সব অশুভ শক্তির অবসানে বেজে উঠবে আগমনীগান।
দিনের উঠোনে ছড়ানো কুমকুম রোদের ভূমিকা। বাতাসে ধুপ ধুনোর আন্তরিকতা ।
এ সবই যেন পুরাণপাতায় ছুঁয়ে থাকা অনন্তের অন্তহীন বয়ে যাওয়া।
ভোরের আকাশি উচ্ছ্বাসে আলোর অন্তরাল।
মাটির গর্ভে গর্জে উঠছে বৈদেহীর কান্নাজল!পুরাণ তার আড়াল সরিয়ে জাগিয়ে তুলছে উল্লেখ।অদৃশ্য চিকের আড়াল থেকে ধ্বনিত হচ্ছে বেদ উপনিষদ ত্রিপিটকের উচ্চারণ।
জলের গায়ে ভেঙে যাচ্ছে ঢেউয়ের অনুনয় ।স্রোতের গর্জন আছড়ে পড়ছে বালির ঐশ্বর্যে। অন্ধকারের আসক্তি ছিঁড়ে জেগে উঠছে ভূমিশরীর। সমস্ত অশুভের বিনাশ শেষে দেবীপক্ষের আগমনবার্তা।তর্পনের জলে বিলিয়ে দেওয়া পিতৃপক্ষের সব আঁধার।
আগমনীর সুর সব অন্ধকার মুছে মুক্তির রাঙা নথ পড়িয়ে দেবে ভোরের অনাশক্তিতে। যজ্ঞসূত্রে ভক্তির নম্র উচ্চারণ। মঙ্গলঘটে আমশাখার উন্মেষ।
ভূমন্ডলে ধ্বনিত হচ্ছে স্তোত্রগানঃ
যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী ।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী।
এই আবহমান আসা যাওয়ার খেলায় কুয়াশাভোর আলোর বিভূতি বিলিয়ে নিবিড় হবে সৃষ্টির আলিঙ্গনে। আনন্দ আর খুশির জড়োয়ায় ভেসে উঠবে কাশবন,সবুজ মাঠ ঘাট, পাখ পাখালি, মানুষ।
আজ সেই খুশির চাঁদোয়ায় পেখম মেলেছে ভয়ের ডানা।আড়াল করছে সোনালি খুশির কিরণ। মাটির কাঠামোয় মনমরা সকাল।জন্ম মৃত্যুর মাঝে এক অদৃশ্য শাদা রুমাল।কার নাম লেখা হবে এবার আশা আর স্বপ্নের ঘরে তালা ঝুলিয়ে!
আজ দেবীপক্ষের সূচনায় সমস্ত আঁধার সরিয়ে ফিরবে কি সেই আলোর প্রজন্ম!
সেই উজানস্রোত, সেই জীবনের ধ্বনি!
হে জাগ্রত দেবী, ঢালো করুণাকিরণ,
এ জীবন তো তোমারই, একান্ত শাসন!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।