গল্পে মৌসুমী ঘোষ

আয়া ও দরজা 

এক

আমার শ্বশুরমশাই সাড়ে তিনবছর অপেক্ষা করেছিলেন মৃত্যুর জন্য।
আমার মা একমাস বারো দিন অপেক্ষা করেছিলেন মৃত্যুর জন্য।
আমার শাশুড়ি দু’হাজার আটের পর থেকে অপেক্ষা করে আছেন মৃত্যুর জন্য।
আমার মা মারা যাবার দিনপনেরো আগে যে আয়াটিকে আয়া সেন্টার থেকে মাকে সেবা-শুশ্রূষার জন্য রাখা হয়েছিল, আমার শ্বশুরমশাই মারা যাবার মাস তিনেক আগে তাকেই খোঁজ করে আনিয়েছিলাম শ্বশুরমশাইকে সেবাযত্ন করার জন্য।আয়াটি শ্বশুরকে ওষুধ খাওয়ানো, চান করানো, খাওয়ানো ছাড়াও বাড়িতে কেউ এলে দরজাও খুলে দিত।
বাড়িতে কলিংবেল বাজলে কে আসলো, কোনো আত্মীয়-স্বজন না বন্ধু-বান্ধব, দুধওয়ালাও হতে পারে, ঠিকে কাজের লোক কিংবা সবজি বা মাছ-ওয়ালা, এসব নিয়ে আমরা যখন ভাবছি, তার আগে আয়াটি নিজেই সিদ্ধান্ত নিত দরজা খোলার। আমাদের থেকে আয়াটি দরজা খোলার সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি নিতে পারতো। কারণ সে জানত যেই আসুক সে দরকারে এসেছে। দরকার ছাড়া এখন আর কেউ কারো বাড়ি আসে না। দরকারে যখন এসেছে তখন যে এসেছে তার নিশ্চয়ই তাড়া আছে।

দুই

শ্বশুরের জন্য নিযুক্ত আয়াটির নাম ছিল সেবা। শাশুড়ি সেবাকে মাঝে মাঝেই হুকুম করতেন, ‘সেবা আমার কাপড়্গুলো ছাদ থেকে এনে দে, কোমরে তেল মালিশ করেদে।’ সেবা প্রথম প্রথম দু’একদিন করে দিলেও পরে নানা বাহানায় শাশুড়িকে ‘কাজ আছে,এখন হবে না’ বলে দিত। একসময়শাশুড়িখুব রেগে আমাকে ডেকে বললেন,‘তোমাদের আয়া অযথা কেউ এলেই দরজা খোলবার জন্য ছুটে যেতে পারে এদিকে আমি কিছু বললে করতে চায়না। ব্যাপারটা কী বলতো ?’ শুধু শাশুড়িনয় আমরাও খেয়াল করেছিলামবাড়িতে কলিংবেল বাজা মাত্রই সেবা সব কাজ ফেলে দরজা খোলার জন্য ছুটে যেত।এর জবাবেসেবা বলেছিল,‘যে আসবে বলে আমি প্রতিনিয়ত রুগীর বাড়িতে থাকাকালীন ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিই সে চলে এলেই আমার ছুটি। তাই আমি দরজা খুলতে ছুটি।’
আমি সেবাকে বললাম, ‘তুমি কি করে এতটা নিশ্চিত ভাবে বলছো – একজন আসবে, যে আসলে তোমায় ছুটি দেবে!’ সে আবার জোরের সঙ্গেই বলল, ‘তোমাদের সেটা বুঝতে হলে তোমাদেরও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা মানুষদের সেবাযত্নের কাজে নিযুক্ত হতে হবে।’ আমার স্বামী পাশ থেকে বলেছিলেন, ‘দার্শনিক-আয়া।’ আমি বললাম, ‘বহুবার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে ওর পেশা ওকে দার্শনিক করে তুলেছে বোঝাই যাচ্ছে।’ শ্বশুরমশাই শেষের দিকে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতেন না। বাড়াবাড়ি মনে হলে আমরা মাঝে মাঝেডাক্তারকে বাড়িতে কল দিতাম। শেষের সে দিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে, প্রতিবারের মতো ডাক্তারকে কল দিয়ে আমরা শ্বশুরের বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছি থমথমে মুখে। প্রতিবারের মতোই শাশুড়ি শ্বশুরের পায়ের কাছে বসে কাঁদছেন। এরমধ্যে কখন কলিংবেল বেজেছে কেউ শুনতে না পেলেও, সেবা কিন্তু ঠিক শুনেছিল। আর যথারীতি ‘তিনি এসে গেছেন’ বলেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। হ্যাঁ, সেদিন সে এসেছিল সেবাকে ছুটি দিতে।

তিন

যদিও দু’হাজার আট থেকে আমার শাশুড়ি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছেন, তবু তার সেবাযত্নের জন্য আজও কোনো আয়া রাখা হয়নি। শাশুড়িকে দেখাশুনার কাজটা আমি নিজেই করি। মাঝে মাঝেই শাশুড়ি আমার কষ্টের কথা ভেবে আয়া রাখার জন্য পীড়াপীড়ি করেন তবু আমি তাঁকে দেখাশুনার জন্য আয়া রাখার ব্যবস্থা করার কথা ভুলেও ভাবি না। কারণ আয়ার যত্নে নিজের মা, শ্বশুর, দু’জনকেই হারিয়েছি।
এখন শাশুড়িকে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস করাতে নার্সিং হোমে নিয়ে যাই আমি, রোজ দু’বেলা ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দিই আমি, এরসঙ্গে বাড়িতে কলিংবেল বাজলেই দরজা খুলি আমি। কারণ আমার জানার খুব কৌতূহল, ‘বাড়িতে মুমূর্ষু রোগী থাকলে কে আসে আয়াদের ছুটি দিতে?’

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।