• Uncategorized
  • 0

মার্গে অনন্য সম্মান মিতা দাস বিশ্বাস (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার   

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৪৭
বিষয় – জ্যৈষ্ঠের দাবদাহ / পাহাড়ী ঝর্ণা

ঝিমলী

অতনু বহু বছর বাদে শিলং বেড়াতে এসেছে ।এটা ওর ভীষন ভালো লাগার জায়গা ছিল। বাবা এক গরমের ছুটিতে নিয়ে এসেছিল সবাইকে ।তখন ও শীলংকে দেখেছিল অন্যভাবে।তখন এতো উন্নত এতো বসতি ছিলো না ।তখন প্রকৃতি ছিলো আরো উদার। ও দেখেছিল পাহারের গা থেকে ঝরঝর করে ভীষন আওয়াজে জলরাশি নেমে আসছে।অবাক হয়ে ও দেখছিল ।ও আরো দেখছিল ঐ জলে সুর্যের তৈরী রামধনু ।কি সুন্দর ।বাবা হাতধরে কাছে টেনে নিয়ে গেলো ।বললো,এটা পাহাড়ী ঝর্না ।আর বর্ষার পর এর রুপই আলাদা । অতনু সেদিন বাবাকে বলেছিল ,বাবা এটা কি স্বর্গ ।বাবা হেসে বলেছিলো ,হ্যাঁ বলতে পারিস। রামধনুর সাতরঙ জলে কেমন খেলা করছে দেখেছিস বেটা।আর জলের তোড়ে কুয়াশা ছেয়েছে । অনেকক্ষণ বসেছিল ওরা ঐ ঝর্নার ধারে ।না তখন ছবি তোলার অত প্রচলন ছিল না । অতনু মনের ক্যানভাসে ছবিটা এঁকে এনেছিল। বাবাকে বলেছিল ,বাবা এই ঝর্নাটার নাম নেয়? না বেটা এর সৃষ্টি হঠাৎ আবার হারিয়ে যাওয়ার অনিশ্চিত ।পাহাড়ি ঝর্ণা বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে পাহাড়ের চুড়ায় জমে থাকা জল নিয়ে পাহাড়ের কোল বেয়ে নামে নাচতে নাচতে। কতোগুলো সারাবছর থাকে কতোগুলো স্রোত হারায়।
এরপর অতনু বন্ধুদের নিয়ে আসে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ।মা না না করছিলেন।বাবা বললেন,আর কতোদিন আঁচলের ছায়ায় ছেলেকে রাখবে গিন্নি। বাঁধন আলগা করো । ওকে এবার নিজের পৃথিবী নিজেকে চিনতে দাও । অতনুকে বললেন,যা বেটা ঐ ছোটোবেলায় দেখা পাহাড়ি ঝরনাটার মতো দাপিয়ে বেড়া । অতনু বন্ধুদের নিয়ে হৈ হৈ করে দ্বিতীয় বার শিলং এলো ।আগের দেখা শিলং ছিলো বাবার চোখে ।এবার নিজের মতো করে দেখবে ও ।মনে রেখেছিল ঝরনাটা কোথায় । বন্ধু রনিতকে বললো ,এক জায়গায় যাবি ? রনিত বললো , কোথায় রে ? আমার প্রথম প্রেমিকার কাছে নিয়ে যাব কাল ভোরে ।যাবি তো ?রনিত বললো ,এ আর বলতে। পরদিন ভোর হতেই দুবন্ধু বেড়িয়ে পরল ।একটু দুরে ছিল ওদের গন্তব্য ।ভোরের পাহাড়ে হাঁটতে কোনো আলস্য আসে না । চারিদিক ঝকঝক করছে ।কতো পাখি ডাকছে ।কতো নাম না জানা ফুল পথের ধারে ফুটে আছে ।ওরা দুইবন্ধু এসব দেখতে দেখতে সেই ঝর্নার কাছে এসে পৌঁছাল ।না হারায় নি ,এখনো পায়ে মল বাজিয়ে পাহাড়ের গায়ে নাচতে নাচতে মাটি ছুঁচছে ।তন্ময় বললো,রনিত এই আমার প্রেম ।আয় দেখবি আয় আমার প্রেমিকাকে সুর্য কেমন রামধনু রঙে শাড়ি পড়িয়েছে ।রনিত হাঁ করে দেখছিল।বললো,ভাই স্বর্গ তো ।এর টানে এসেছিস ? বেশ করেছিস ।দুই বন্ধু সামনে একটা রক করে দিয়েছে ।ওরা ওখানে বসলো ।হটাৎ রনিত বললো ,তন্ময় তুই কি আমি যা দেখছি তা দেখতে পাচ্ছিস?
তন্ময় তাকিয়ে আছে ঝর্নার জলের দিকে ।একটা মেয়ে স্নান করছে । অদ্ভুত সুন্দর সে ।কোমর পর্যন্ত চুল ,ফর্সা শরীর , ছিপছিপে চেহারা । একদম ঝর্নাটার কাছে গিয়ে স্নান করছে ।বিহ্বলের মতো দেখছে দুজন।মেয়ের কিন্তু হুঁস নেয় ।হটাৎ একটা চিৎকার শুনলো ,কেউ চিৎকার করতে করতে আসছে ।ও ঝিমলি কৈ তুই ?ভোর হতেই জলে নেমেছিস ? আজ তোর পিঠে চেলাকাঠ ভাঙব আমি ।শয়তানি ভরা শাওনের পর ঐ ভরা জলে নামতে তোর ডর লাগে নারে । ঝিমলি নামের মেয়েটি দৌড়ে এসে অতনুর পেছনে লুকালো। ফিসফিস করে বললো,ই বাবু তুই কিছু দেখিস নাই।মাকে যদি বলেছিস তো গায়ে জোক ছেড়ে দেব । অতনু চুপচাপ বসে থাকলো।ওর মা এসে মেয়েকে না পেয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল ।লুকাইছিস তো ,ঠিক আছে আজ তোকে খেতে কে দেয় ।তোর মলের শব্দ আমি পেয়েছি । অতনু ঘোরের মধ্যে বললো,আর একটা পাহাড়ি ঝর্না আমার বুকে ধরা দিল।
এর মধ্যে দামাল ঝিমলি পেছন থেকে বেড়িয়ে এসে ধপ করে অতনুর পাশে বসে বললো ,চা খাবে তোমরা ? রনিত হেসে বললো, কিভাবে?দাঁড়াও আমি ডাকছি । কিন্তু একটা শর্তে ।কি শর্ত বলো? আমাকেও খাওয়াতে হবে। আমার মা আজ ক্ষেপেছে ।তারপর অতনুর দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার বন্ধু কি বোবা ? রনির বললো, না ওর বুকে আর একটা ঝর্না আছরে পরেছে কিনা তাই একটু সামলে নিচ্ছে। মেয়েটি তখন বললো , আমার নাম তো জেনেই গেছ । তোমাদের নাম বলো।রনিত বললো, আমি রনিত রায় আর ও আমার বন্ধু অতনু সিনহা ।ও তোমরা বুঝি বেড়াতে এসেছ ? হ্যাঁ তাই । তোমার চা কৈ ঝিমলি? ঝিমলি বললো , দাঁড়াও আমি আসছি । ঝিমলি মল বাজিয়ে দৌড় লাগালো ।
রনিত অতনুকে বললো,ভাই বাস্তবে ফিরে আয় ।অতনু হেসে বললো ,দুর্দান্ত মাইরি ।একদম বোল্ড আউট করে দিল ।যা বলেছিস দেখতে ফাটাফাটি মেয়েটি ।রনিত আমি কিন্তু প্রেমে পরে গেছি ।সে না বললেও বোঝা যাচ্ছে। এরমধ্যে ঝিমলি শাড়ি বদলে একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছে ।রনিত বললো , ঝিমলি এ কে ?ও আমার গাঁয়ের ছেলে ।খাও চা খাও । বিস্কুট খাবে ?ওরা সকলে চা বিস্কুট খেল । ছেলেটার কথায় জানা গেল ঝিমলি ঐ দুরের বস্তীটাতে থাকে ।পড়াশোনায় খুব ভালো বলে ওর বাবা ওকে কোলকাতা শহরে পাঠিয়েছে ।ওখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছে ।আরো বললো, ঝিমলি দিদিকে সক্কলে বলে পাহাড়ী ঝর্না ।ওতো লাগাম নেই ,হুরহুর করে পাহাড়ের গায়ে নাচতে নাচতে নামে ,ইও তাই ।পায়ের কোনো লাগাম নেই ।উজন্যই তো কাকি মল পরাই দিছে । কোথায় আছে সিটা অন্তত বোঝা যায় ।বলে হি হি করে হাসতে লাগলো ।
অতনু এতোক্ষণে মুখ খুললো,বললো কোন স্কুলে পড়েন ঝিমলি? ঝিমলি বললো ,কোনো নামি স্কুলে নয় ।অত পয়সা কোথায় ? তোমরা কি করো।রনিত বললো ,আমরাও উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে এসেছি । আরো বন্ধুরা আছে হোটেলে ।ও ছোটো বেলায় এই ঝর্নাটার কাছে এসেছিল তাই আমরা দেখতে এসেছি সময়ের সাথে ও পাল্টায় নিতো? ঝিমলি বললো ,নাগো এতো মানুষ নয় যে পাল্টাবে ।এ প্রকৃতি ,ও শুধু দিতে জানে । তবে ক্ষেপে গেলে সব শেষ করে ছাড়ে ।তাহলে অতনু আজ থেকে ঝিমলি আপনাদের বন্ধু ।অবশ্য গরীব ঝিমলি কি বন্ধু হতে পারবে?রনিত বললো,অতনু তো প্রথম দেখাতেই তোমাকে বন্ধু করে ফেলেছে ঝিমলি । আমরা যে কদিন আছি তোমার মলের আওয়াজ পাব তো ? এখানে আসতে হবে তবে । আমি কোথাও যায় না বাড়ি এলে ।মা পিটায় ।ঠিক আছে ঝিমলি আসব। তোমার গাঁ দেখবো ।ঠিক আছে ।
পরদিন ভোর হতেই অতনু হোটেল থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝর্নার ধারে এসে বসে ।কান পেতে থাকে কখন জ্যান্ত ঝর্নার পায়ের মল বাজবে । হটাৎ শুনল সেই শব্দ । ঝিমলি এসে একগাল হেসে বললো ,কখন এসেছ? অনেকক্ষন, এতো দেরি করলে আজ।মা ছাড়ছিলো না । বল্লাম ,যে কদিন আছি যাই স্নান করে আসি।ঐ ঝর্না তো আমার সাথী গো ।সেই ছোট্ট থেকে আমি ওর সাথে সময় কাটায়। তারপর মা ছাড়লো। তুমি যাবে আমার সাথে ? না তুমি স্নান করো আমি বসি ।ও নেমে গেলো ঝর্নার জলে।জলপরীর মতো লাগছিলো ওকে ।পুরো জলটাতে ওলটপালট করছিলো মেয়েটা । অনেকক্ষন বাদে উঠে এসে বললো, বন্ধু চা খাবে না ? আমি বললাম ,খাব ।ঐ দেখো ছটকু আসছে ।এভাবে অতনু আর ঝিমলি একে অপরের কাছে আসে । প্রথমে ওরা ভালো বন্ধু হয় । অতনু ভালোবেসে ঝিমলিকে বলতো, পাহাড়ি ঝর্ণা । কিছুদিন বাদে অতনু কোলকাতায় ফিরে আসে । ঝিমলিকে আসার আগে একটা ফোন উপহার দেয় । ঝিমলি কিছুতেই নিতে চাই নি ।অতনু ঝিমলির বাড়িতে আসা যাওয়া করতে করতে ওদের আপনজন হয়ে গিয়েছিল ।ওর বাবা বলতো, এতোদিন মেয়েটা বিদেশ বিভুঁইয়ে একা ছিল বেটা ।আর চিন্তা রইলো না , তুমি এখন ওর সাথী ।ওরা বলে , ঝিমলি ফোনটা নিয়ে নে মা ।ওটা খুব প্রয়োজনের জিনিস । আমার তো ক্ষমতা নেয় মা ।তোর খবরটা পাব এবার ।তারপর ঝিমলি ফোনটা নেয়।
অতনু বাড়ি ফিরে মা, বাবাকে সব বলে ।ছবিও দেখায় ।বাবা বলেন , খরস্রোতা পাহাড়ী ঝর্ণা বেটা ।ও বাঁধা পড়বে তো ? দিন,সময় বলবে তোর ভালোবাসা ওর বাঁধন হয় কিনা । হয়েছিল , ঝিমলি অতনুর ভালোবাসায় বাঁধা পরেছিল । অতনুর বাবা পাহাড়ের সরল মেয়েটাকে ভীষন ভালো ভেসে ফেলেছিলেন।উনি কথাবার্তা বলে ঝিমলিকে ঘরের বৌ করে আনেন। ঝিমলি বলেছিলো আমি পড়বো ।অতনু বাঁধা দেয় নি । অতনু ওকে নিয়ে ভীষন খুশী ছিল । ভগবান আবার কারো সুখ সয়তে পারেন না । ঝিমলি বর্ষায় বাড়িতে এসেছিল । স্নান করতে ঝর্নায় নেমেছিলো।হটাৎ হরকা বান নামে ।বড়ো বড়ো পাথরের তলায় ঝিমলির নিথর শরীরটা পাওয়া যায় ।অতনু পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল । জীবনের সব উচ্ছাসগুলো ঝিমলি নিয়ে গিয়েছিল । নিজেকে বন্দী করে রেখেছিল দশ বছর ।আজ ও চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে ।একদম একা ।তাই আবার শিলং এসেছে । ঝর্নার পাশে বসে আছে।ঐ ঘটনার পর ঝর্ণাটাকে বেঁধে দিয়েছে।কাছে যাওয়া যায় না।অতনু মনে মনে বললো,ঠিক হয়েছে । তুই যেমন আমার ঝর্নাকে কেড়ে নিয়েছিস তুইও তেমন বাঁধা পরেছিস। তোকে এখন আমার একটুও ভালো লাগছে না ।আর আসবো না তোর কাছে ।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।