• Uncategorized
  • 0

T3 || অবিস্মরণীয় নজরুল || বিশেষ সংখ্যায় মানস চক্রবর্ত্তী

বিচিত্র নজরুল

‘যদি বাঁশি না বাজে’তে নজরুল লিখেছেন , রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রায়ই বলতেন , “দ্যাখ উন্মাদ , তোর জীবনে শেলির মতো কিটসের মতো খুব বড়ো একটা ট্র্যাজেডি আছে , তুই প্রস্তুত হ |” একথা কি দারুণ ভাবে সত্য নজরুল আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও সমান অবহেলিত |
জীবিতকালে নজরুল ব্যথা পেয়েছেন তাঁর সঙ্গে কবিগুরুর তুলনা করে তাঁকে অযথা ছোটো করার চেষ্টা দেখে | সে চেষ্টা এখনও অব্যাহত | ‘আমার কৈফিয়তে’ তাই তিনি লিখেছেন , “বড় কথা বড় ভাব আসেনাক ‘ মাথায় , বন্ধু , বড় দুখে ! অমর কাব্য তোমরা লিখিও , বন্ধু , যাহারা আছ সুখে ! পরোয়া করি না , বাঁচি -না বাঁচি যুগের হুজুক কেটে গেলে , “
সত্যিই তিনি কোনো কিছুর পরোয়া কোনোদিনই করেননি | “আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ ! ”
আপনাকে কুর্ণিশ করার অর্থ নিজের প্রতি বিশ্বাস, আত্মসম্মানবোধ | জগতকে কিছু দেওয়ার জন্য নিজস্ব প্রস্তুতি | এই প্রস্তুতি তাঁকে করেছিল চির উন্নত শির |
নিজের গান নিয়ে তিনি খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন | “সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই তবে এইটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি |” তাঁর গানের সৃষ্টি সম্ভার কত বিচিত্র | আধুনিক, ভাটিয়ালি , কীর্তন , ভজন , শ্যামাসংগীত , গজল , রাগপ্রধান , লোকগীতি , ব্যঙ্গগীতি – কত ধরণের গান তিনি সাবলীলভাবে সৃষ্টি করেছেন |
সম্পাদক ও সাংবাদিক নজরুল আজ প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে | অথচ তিনি ‘নবযুগ’ , ‘ধুমকেতু’ , ‘লাঙল’ , ‘গণবাণী’ , ‘সেবক’ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন | একবার ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যু্র পর ‘সেবক’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলমে একটি লেখা লিখেছিলেন | প্রধান সম্পাদক ওয়াহেদ সাহেব ওই লেখায় হস্তক্ষেপ করায় নজরুল খুব ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি সেবকের কাজ ছেড়ে দেন | ১৯২২ সালে ২২ আগস্ট প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশ করেন ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা | স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পাঠালেন আশীর্বাণী : “আয় চলে আয় ধূমকেতু / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু / দুর্দিনের এই দুর্গশিরে / উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন / অলক্ষণের তিলকরেখা / রাতের ভালে হোক না লেখা / জাগিয়ে দে রে চমক মেরে / আছে যারা অর্ধচেতন |”
ঐবছরই ২৬ সেপ্টেম্বর ‘শারদীয়া ধুমকেতু’তে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় নজরুল লিখলেন , “আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল ? / স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল | / দেবশিশুদের মারছে চাবুক , বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি , / ভূ-ভারত আজ কসাইখানা ,- আসবি কখন সর্বনাশী ? “
পড়লেন রাজশক্তির রোষানলে | একবছরের কারাদণ্ড হলো | ১৯২৩ এর ১৫ ডিসেম্বর বহরমপুর জেল থেকে ছাড়া পান | আমার তাঁর লেখালেখি শুরু | ‘লাঙল’ , ‘গণবাণী’ , ‘নবযুগ’এ লিখলেন জ্বালাময়ী সব সম্পাদয়ীক কলম | ‘নবযুগ’ এ ‘ধর্মঘট’ নামক এক প্রবন্ধে লিখলেন , “….. কিন্তু আর আমরা দাঁড়াইয়া মার খাইব না , আঘাত খাইয়া খাইয়া অপমানে বেদনায় আমাদের রক্ত একেবারে গরম হইয়া উঠিয়াছে | কেন, তোমাদের আত্মসম্মান জ্ঞান আছে , আর আমাদের নাই ? আমরা কি মানুষ নই ? স্বাধীনতাকে মনুষ্যত্বকে এমন নির্মমভাবে দুই পায়ে মাড়াইয়া চলিবে আর কতদিন ? এই অত্যাচারের এই মিথ্যার বুনিয়াদে খাড়া তোমাদের ঘর ? মনে কর কি , চিরদিন খাড়া থাকিবে ? “
ধর্মীয় কুসংস্কার ও জাতপাতের বিধিনিষেধ তিনি বরাবরই ঘৃণা করে এসেছেন | “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াদ খেলছ জুয়া / ছুঁলেই তোর জাত যাবে ? জাত ছেলের হাতের নয়কো মোয়া |” তাঁর জীবনটাই তার বাণীর পরাকাষ্ঠা | তাঁর রচিত গানে অসংখ্য শ্যামাসংগীত , শ্রীকৃষ্ণ ভজন আছে | এই নিয়ে রক্ষণশীলদের রোষানলে পড়েছেন তিনি | আমার ‘কৈফিয়ত’এ লিখছেন, “দেব-দেবী নাম মুখে আনে , সবে দাও পাজিটার জাত মেরে !” বুলবুল মারা যাওয়ার পর তিনি খুব বিচলিত হয়ে পড়েন | সান্ত্বনা লাভের আশায় যোগী বরদাচরণের কাছে যোগসাধনায় দীক্ষা নেয় | ‘ভক্তিগীতি মাধুরীর’ ভূমিকায় নজরুল লিখেছেন , “সহসা একদিন তাঁহাকে দেখিলাম |….শুভক্ষণে আনন্দবাসরে আমার যে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম |….আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই , তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি | আমার ব্রহ্ম-ক্ষুধা আজও মেটে নাই কিন্তু সে ক্ষুধা এই জীবনেই মিটিবে , সে বিশ্বাসে স্থিত হইতে পারিয়াছি | ” ( bengali.indianexpress.com থেকে গৃহিত ) | আমরা আরো জানতে পারি তিনি বিয়েও করেছিলেন হিন্দু মেয়ে প্রমীলা দেবীকে | যাঁর প্রকৃত নাম ছিল আশালতা সেনগুপ্ত | ডাকনাম দোলোনা | সংক্ষেপে দুলি | প্রমীলা নাম তাঁরই( নজরুলের) দেওয়া | অর্থাৎ জাতপাত , ধর্মীয় ভেদাভেদের অনেক উপরে অবস্থান করতেন তিনি |
একথা স্বীকার করতেও দ্বিধা নেই সাংসারিক বন্ধনের অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থিতি ছিল | প্রথমা স্ত্রী নার্গিসকে লেখা পত্রে একথা ধরা আছে | তিনি লিখছেন , “আমি সংসার করছি , তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে |” সত্যিই তাই , নজরুল আমাদের মতো বদ্ধ মনের মানুষ ছিলেন না | ‘সংকল্প’ কবিতায় লিখেছেন তাঁর মনের বাসনা- “রইব নাকো বদ্ধ খাঁচায় দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-/ আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে | / আমার সীমার বাঁধন টুটে / দশদিকেতে পড়ব লুটেঃ / পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ / বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে ||” এই জগৎ প্রেমেই তিনি খেয়ালী বিধির বক্ষ করেছে ভিন্ন |
কোন্ অতীতে চণ্ডিদাস বলেছেন ,”সবার উপরে মানুষ সত্য |” রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “নমি নরদেবতারে …” নজরুলও তার ব্যতিক্রম নন |কবিগুরুর মতো তাঁর কাছেও মানুষ দেবতা | “তারাই মানুষ , তারাই দেবতা , গাহি তাহাদেরি গান |” তিনি মানুষের অপমানে কেঁদেছেন | “চোখ ফেটে এলো জল , / এমনি ক’রে জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল ? ” যেখানে অত্যাচার লাঞ্ছনা সেখানেই তিনি প্রতিবাদে মুখর | তিনি অত্যাচারীর সর্বনাশ কামনা করেছেন | তিনি প্রার্থনা করেছেন , “প্রার্থনা ক’রো -যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস , / যেন লেখা হয় আমার রক্ত- লেখায় তাদের সর্বনাশ !” মানুষের অপমানে পীড়নে তিনি ব্যথিত | তিনি চঞ্চল | কী দারুণ অপমানে তিনি বিদ্রোহী সত্ত্বা | তিনি লিখছেন “আমি সেই দিন হব শান্ত , / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল , আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না , / অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না | “
তাঁর কাছে মানুষই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ | মানুষের ভেদাভেদ তিনি মেনে নিতে পারেননি | ‘মানুষ’ কবিতায় তাই তিনি লিখলেন , “ও কে ? চণ্ডাল ? চম্ কাও কেন্ ? নহে ও ঘৃণ্য জীব ! / ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র , ওই শ্মশানের শিব |” তিনি সমস্ত জীবন ধরে মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন | সমস্ত অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁর কলম সাম্যের জয়গান গেয়েছেন | “গাহি সাম্যের গান / মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই , নহে কিছু মহীয়ান / নাহি দেশ কাল পাত্রের ভেদ , অভেদ ধর্মজাতি / সব দেশ সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি |”
তিনি খুব সম্মান করতেন নারী জাতীকে | শ্রদ্ধা জানিয়েছেন | যেখানে পুরুষ চেয়েছে কর্তৃত্ব করতে সেখানেই তাঁর প্রতিবাদ “কোনকালে একা হয়নি ক’ জয়ী ,পুরুষের তরবারি ; / প্রেরণা দিয়াছে , শক্তি দিয়াছে , বিজয়-লক্ষ্মী নারী | ” স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংস এবং সহিংস উভয় আন্দোলনে নারী সমাজের এক বিরাট ভূমিকা ছিল | অথচ সেভাবে ওরা ইতিহাসে স্থান পেলো না | তাদের দুঃখে ব্যথিত নজরুল লিখলেন , “কোন্ রণে কত খুন দিল নর , লেখা আছে ইতিহাসে / কত নারী দিল সিঁথির সিঁদূর , লেখা হয় নাই তার পাশে |”
তিনি ছিলেন তারুণ্যের কবি | ‘ছাত্রদলের গান কবিতায় তাই লিখলেন , “মোদের কক্ষচ্যুত ধূমকেতু-প্রায় / লক্ষহারা প্রাণ , / আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর / নিত্য বলিদান |” তিনি চৈরিবেতির মন্ত্রে বিশ্বাসী | তিনি গাইলেন , “চল্ চল্ চল্ ! / ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল / নিম্নে উতলা ধরণী তল / অরুণ প্রাতের তরুণ দল / চল্ রে চল্ রে চল্ | “
পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় শিশুমনের বন্ধু হওয়া | সেই অর্থে নজরুল সফল | কারণ তিনি কবিতায় গানে শিশুমনকে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন | না হলে কখনোই লিখতে পারতেন না ,”আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! / একটি আমায় দাও ! / কাঠবেড়ালি ! তুমি আমার ছোড়দি হবে ? বৌদি হবে ? হুঁ , / রাঙাদিদি ? তবে একটা পেয়ারা দাও না ! উঁঃ ! ” অথবা “মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে নেচে যায় …” |
আসলে তিনি ছিলেন এক মজার মানুষ | অন্তর ছিল চির সরস | একদিনের ঘটনা তিনি তখন গ্রামোফোন কোম্পানীতে আছেন | কোনো একদিন দোতলায় বসে আছেন | কর্মচারী ছেলেটি এসে খবর দিল , “কাজীদা ইন্দুদি ( গায়িকা ইন্দুবালা ) আপনাকে নীচে ডাকছেন |” নজরুলও কৌতুকভরে উত্তর দিলেন , “আর কত নীচে নামব ভাই ?” মাঝে মাঝে ‘ধুমকেতু’র অফিসে বসে চা খেতে খেতে বলে উঠতেন , “দে গরুরু গা ধুইয়ে |” হাস্যরস সৃষ্টিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত | “আমার হরিনামে রুচি , কারণ পরিণামে লুচি / আমি ভোজের লাগি করি ভোজন |”
লেখাটির উপসংহারে মনে পড়ছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি কবিতা |”ভুল হয়ে গেছে বিলকুল , / আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে , / ভাগ হয়নি ক’ নজরুল |” নজরুল নিজে সাম্প্রদায়িক বিরোধ দেখে ব্যথিত হয়েছেন | তাই তাঁর জাতির কাছে , সমাজের কাছে জিজ্ঞাসা : “হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন ? / কাণ্ডারী ! বল ডুবিছে মানুষ -সন্তান মোর মা’র |” তিনি চেয়েছিলেন মিলন | ” মোরা একই বৃন্তে ,দুটি কুসুম ,হিন্দু-মুসলমান , / মুসলিম তার নয়নমণি , হিন্দু তাহার প্রাণ |” নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে নজরুল বলেছেন , “সুন্দরের ধ্যান , তার স্তবগানই আমার উপাসনা , আমার ধর্ম | যে কুলে , যে সমাজে , যে বংশে , যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি , সে আমার দৈব | তাকে আমি ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি |”
হে কবি , হে সুন্দরের উপাসক তোমাকে প্রণাম , তোমাকে প্রণাম |
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।