গল্পের জোনাকিতে মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী

মৈত্রেয়ীর মাতৃদিবস

সকালে উঠে স্নান সেরে রান্নাঘরে ঢুকেছেন মৈত্রেয়ী। প্রথমেই পায়েস চাপাবেন আজ। একমাত্র ছেলে চিরন্তনের জন্মদিন। আরও অনেক কিছুই হবে তবে সেসব রান্না তুলিকা এসে করবে। গত পাঁচ বছর ধরে সে এ বাড়ির রান্নার পাট সামলাচ্ছে। শুধু পায়েসটা তিনি নিজে হাতে করবেন, প্রতি বছরই করেন।
ছেলে থাকে সল্টলেকের একটি বিলাসবহুল বহুতলে। শহরের উপকণ্ঠে ছোট মফঃস্বল শহরে ছিমছাম দোতলা বাড়িতে উপর নীচে করে চারটি ঘর তাঁদের। বাসিন্দা বলতে তিনি আর চিরন্তনের বাবা শঙ্কুদেব। এখানে থাকার কোনো অসুবিধা ছিল না। তবে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার চিরন্তনের লাইফস্টাইল এই মফঃস্বলের সঙ্গে খাপ খায় না। নাতনি কলকাতার নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। এখানে থেকে সেসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যেত না। চেষ্টা করলে একেবারে যে যেত না তা নয়। এখান থেকে অনেক ছেলেমেয়েই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলে বৌমা যখন কলকাতায় থাকার সুবিধার কথা বোঝাতে এসে এসব যুক্তি খাড়া করে তখন কোনো বিরুদ্ধ যুক্তিতর্কের মধ্যে যাননি মৈত্রেয়ী বা তাঁর স্বামী। তাঁরা জানেন কোথায় কতদূর পর্যন্ত সীমারেখা টানতে হয়। জোর করলে সম্পর্কে তিক্ততাই বেড়ে যেত শুধু তাই সবটাই মেনে নিলেন হাসিমুখে। প্রথমটা খুব কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মনকে বুঝিয়েছেন, মেয়ে হলে বিয়ে দেওয়ার পর দূরে থাকলে মেনে নিতে হয়, অথচ ছেলে দূরে থাকলে এত অভিমান হয় কেন! মনকে শান্ত করেন ধীরে ধীরে। প্রথম প্রথম খুব একা লাগত, পরে অভ্যাস হয়ে গেছে। সব রবিবার না হলেও মাসে একবার দুবার ছেলে বৌমা নাতনি নিয়ে আসে, এক দুদিন থেকে যায়, ভালো সময় কাটে তখন। তবে বই পড়তে ভালোবাসেন, এখন মোবাইল ফোনেও অনেককিছুই আছে যাতে ভালো সময় কাটে। গাছপালা করতে ভালোবাসেন, নিজে পরিশ্রম করে পারেন না তবে লোক রেখে একটা ছোট বাগান করেছেন বাড়ির সামনে। সেখানে ফুল বা সবজি হলে বাগানে ঘুরে ঘুরে দেখেন তাদের, পরম স্নেহে তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। সুতরাং একরকম ভাবে চলে যাচ্ছে।
আজ সকাল থেকে মনটা খুব ভালো মৈত্রেয়ীর। ছেলের বাবাও মনে মনে খুশি হয় তবে স্বভাব গম্ভীর মানুষ বাইরে প্রকাশ করেননি। পাঁচ বছর হয়েছে ছেলে কলকাতায় কিন্তু এই দিনটিতে যত কাজই থাক তবুও সে বাড়ি এসেছে, সম্ভব হলে তিনজন নয়তো একাই। রাতে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে পরদিন এখান থেকে অফিস যায়, এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। আজ সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল। বৌমা সন্ধ্যার একটু আগে ফোন করে জানাল খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ ব্যস্ত থাকায় আসতে পারছে না। হতাশার মেঘটা বুকের ভিতরে ছেয়ে গিয়ে চোখের কোণে বৃষ্টি শুরু করে মৈত্রেয়ীর তবে তিনি অবুঝ নন, নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় নেন শুধু। তারপর স্বামীর কাছে এসে বলেন, ” হ্যাঁ গো, এখন যেসব অনলাইন কুরিয়ার সার্ভিস চালু হয়েছে ওদের দিয়ে খাবারগুলো পাঠিয়ে দেওয়া যায় না?” রেগে উঠে শঙ্কুদেব বললেন, ” তোমার ছেলে মিটিং সেরে ফ্ল্যাটে ফিরে দয়া করে পায়েস মুখে দেবে তার জন্য আমি এতো কিছু করতে পারব না, ফেলে দাও সব।” এরপর যথারীতি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয়ে গেল মান অভিমানের পালা , রাগারাগি করে রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়লেন দুজনেই।
মন বিক্ষিপ্ত থাকায় ঘুম আসছে না মৈত্রেয়ীর। সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাড়ির সামনে গাড়ি থামার আওয়াজ পেলেন। গ্রিলের তালা খোলার আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় এসে দেখেন দরজা খুলে উঠোনে নামলেন শঙ্কুদেব, মেইন গেটের তালা খুলতে। অভিমান কোথায় উধাও হয়েছে, মৈত্রী চিৎকার করে উঠলেন, “এত রাতে একা তালা খুলতে যাচ্ছ কেন?” পিছন ফিরে একটু হেসে বেরিয়ে গেলেন চিরন্তনের বাবা।
গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে মৈত্রেয়ী দেখলেন উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে চিরন্তন, সঙ্গে বৌমা অদিতি আর নাতনি পুপু। বুকের ভিতর হতাশার মেঘটা মুহূর্তে শরতের হালকা মেঘের মতো ভেসে গেল যখন বারান্দায় উঠে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো চিরু। শঙ্কুদেব বললেন, ” ওরা ফ্রেস হয়ে নিক, তুমি খাবার গরম করো”
খাওয়া দাওয়া করতে করতে প্রায় সাড়ে বারোটা বাজলো। ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে অদিতি তাতে আলমারি থেকে বের করে এনে একটা ভালো টেবিল ক্লথ পাতছে দেখে মৈত্রেয়ী বললেন, ” এত রাতে ভালো টেবিল কভার পাতার কি দরকার? কাল সকালে পাতবে।” মৃদু হেসে নিজের কাজ করে যায় অদিতি। চিরন্তন বাবার ঘর থেকে বের করে আনে একটা নামী ব্র্যান্ডের বড় একটা কেকের প্যাকেট। মৈত্রেয়ী লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলেন, ইশ্ আমার মনেই ছিল না, কিন্তু এখন তো বারোটা বেজে গেছে, পরের দিন হয়ে গেল” বলে অদিতির দিকে তাকিয়ে বলেন তোমরা আসার পরেই এটা করতে পারতে।” অদিতি তখনও চুপ করে মিটি মিটি হাসে আর বাতি জ্বালায়। চিরন্তন টেবিলে এনে কেকটা খুলে দিতে দেখে তাতে লেখা, “হ্যাপি মাদার্স ডে”। হাততালি দিয়ে ওঠে পুপু, বলে, “সারপ্রাইজ ঠাম্মি”।
সবার মুখে মৃদু হাসি এমনকি স্বামীরও, বুঝতে পারেন মৈত্রেয়ী , বলেন, “তুমি সব জানতে নয়?” হেসে মাথা নাড়েন শঙ্কুদেব, বলেন, “মিটিংটা ওর সত্যিই ছিল তবে ওরই প্ল্যানিং এ ওর জন্মদিন আর মাদারস্ ডে একসাথে এইভাবে সেলিব্রেট করা হলো” শরতের মেঘটা আবারও মৈত্রেয়ীর চোখের কোণে এক পশলা বৃষ্টি ঝরিয়ে গেল তবে শরতের মেঘ তো, সঙ্গে সঙ্গেই উজ্জ্বল হাসিতে, আলোয় ভরে উঠল মনের আকাশ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *