সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্ত্তী – ২২

নিবেদিতা তাঁর বালিকা বিদ্যালয়ের মাধ্যামে ছাত্রীগণকে মানুষ করবার একটা প্রয়াস পাইয়াছিল | তার অর্থ এই নয় যে তিনি ছাত্রসমাজের প্রতি উদাসীন ছিলেন | “ছাত্রদের জন্য তাই নিবেদিতার একটি কার্যসূচী ছিল | সংক্ষেপে বলা যায় , তিনি চাহিতেন , খেলাধূলা ও ব্যায়ামের দ্বারা তাহারা শরীরের পুষ্টি সাধন করিবে , বিভিন্ন মনীষীর – কেবল স্বদেশের নহে , বিদেশেরও – জীবন ও কর্মপ্রচেষ্টা অধ্যয়ন করিয়া অনুপ্রেরণা লাভ করিবে ; সকল দেশের বিভিন্ন যুগের ও জাতির ইতিহাস পাঠ করিয়া পরিমার্জিত বুদ্ধির দ্বারা বিচিত্র উত্থান – পতনের মধ্যে দিয়া মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসের সহিত পরিচিত হইবে |

১১

নিবেদিতার দৃঢ় ধারণা ছিল সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ ব্যতীত অখণ্ড ভারতের স্বরূপ ধারণা এক প্রকার অসম্ভব | নিবেদিতার অভিপ্রায় ছিল শিক্ষার্থীরা ছয়মাসকাল অধ্যয়ন করুক এবং বাকি ছয়মাস ভারত পর্যটন করুক | বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা , ধর্ম , পোশাক-পরিচ্ছদ , আচার-ব্যবহার , রীতি-নীতি সবই পৃথক হলেও এক মহান আদর্শ দেশের জীবনে এক আশ্চর্য যোগসূত্র ঘটিয়েছে – সেই অখণ্ডতার , সেই আধ্যাত্মিক আদর্শের সম্যক ধারণা কেবলমাত্র দেশ ভ্রমণের দ্বারাই হতে পারে |

তিনি শুধু পরিকল্পনা করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না এর যথাযথ বাস্তব রূপও দিয়েছিলেন | প্রবাজিকা মুক্তিপ্রাণার রচনায় এর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় | “অতএব এপ্রিল মাসে (১৯০৩) কার্য আরম্ভ হইয়া গেল | ‘বিবেকানন্দ হোম’ নাম দিয়া একটি ছাত্রাবাস কলিকাতায় বিবেকানন্দ সোসাইটির তত্ত্বাবধানে খোলা হইয়াছিল | ঐ ছাত্রাবাসের কয়েকটি বালককে লইয়া স্বামী সদানন্দ যাত্রা করিলেন | রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই সঙ্গে ছিলেন | কাঠগোদাম হইয়া কেদারবদরী পর্যন্ত তাঁহাদের অভিযান | নিবেদিতার অনুরোধে এক মহিলা দুইশত টাকা দিলেন | ইহাদের যাত্রার জন্য নিবেদিতার কত চিন্তা , উদ্বেগ ! শেষ পর্যন্ত জননীর স্নেহাঞ্চল ত্যাগ করিয়া বালকগণ যাত্রা করিতে সমর্থ হইবে কিনা , সে বিষয়ে তাঁহার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল | অবশেষে তাহারা রওনা হইয়া গেলে নিবেদিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন |

১২
ছাত্রগণ ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করলে ছাত্রীগণ অপেক্ষা অধিক কঠোর ছিলেন | একবার একটি ছাত্রের বিরূপ আচরণ লক্ষ্য করে বলেছিলেন , “We ought to hammer tham .”

ছাত্রগণ সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ুক তা তিনি চাইতেন না | তাঁর সাবধান বাণী , “আর্টের সাধনা ত্যাগ করিয়া তাহারা যেন পলিটিক্সে যোগদান না করে |”

১৩
ছাত্রজীবনে ‘ব্রহ্মচর্য ব্রত’ পালনের উপর তিনি বিশেষ জোর দিতেন | তিনি তাঁর এক বক্তৃতায় ভারতীয় মাতৃমণ্ডলীর কাছে এক আবেদন তুলে ধরেছিলেন : “হিন্দুমাতা তাঁহার ছেলেদের মধ্যে ব্রহ্মচর্যের তৃষ্ণা পুনরায় জাগাইয়া তুলুন | এছাড়া জাতির পক্ষে তাহার প্রাচীন বীর্যলাভ সম্ভব নহে | ভারত ব্যতীত পৃথিবীতে আর কোথাও ছাত্রজীবনে এমন মহান আদর্শ নাই ; এখানেই যদি উহা নষ্ট হইয়া যায় , তবে আর কোথায় তাহাকে রক্ষা করিবার আশা করা যাইতে পারে ? ব্রহ্মচর্যের মধ্যেই সমস্ত শক্তি ও মহত্ব প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে | প্রত্যেক জননী যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন যে , তাঁহার সন্তানগণ মহৎ হইবে |

১৪
নিবেদিতার শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ করে নারীশিক্ষা বিস্তারে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ছিল অর্থাভাব | নিবেদিতার অর্থাভাব দূর করার জন্য অবসর সময় লেখার কাজে ব্যয় করতেন এবং তা থেকে প্রাপ্য আয় শিক্ষা কার্যে ব্যয় করতেন | এই উদ্দেশ্য লেখা বইগুলি হলো “The Master as I saw Him” , “Cradle Tales of Hinduism” , “Religion and Dharama” , “The web of Indian life” , Notes of some wandering with Sw. Vivekananda” প্রভৃতি |

নিবেদিতার শিক্ষাকার্যে অর্থাভাবে বড়োই ব্যতিবস্ত থাকতেন কিন্তু কোনোরূপ সরকারী সাহায্য গ্রহণে তিনি রাজী ছিলেন না | লেডি মিণ্টোর সঙ্গে আলাপের সূত্রে তাঁর কাছে সরকারী সাহায্য গ্রহণের প্রস্তাব এসেছিল , কিন্তু নিবেদিতা সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন | বিদেশী শাসন উচ্ছেদই তার কাম্য ছিল | ফলে শিক্ষাকার্যে বিদেশি সাহায্য নেওয়া তাঁর কাছে স্বপ্নাতীত ছিল | এমনকী নিবেদিতা যে উইল প্রস্তুত করেছিলেন সেখানে শর্ত করেছিলেন বিদেশি সরকারের সঙ্গে তাঁর বিদ্যালয়ের কোনও প্রকার সম্পর্ক থাকবে না |

মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষার চিন্তা তাঁর সমস্ত অন্তর জুড়ে ছিল | মৃত্যুর পূর্বে বিদ্যালয়ের আয়ের বন্দোবস্ত করে এক উইল প্রস্তুত করেন | “বস্টন শহর নিবাসী উকিল মিঃ ইজি থর্প আমাকে অথবা আমার সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ককে যা কিছু দেবেন , বেঙ্গল ব্যাঙ্কে আমার যে তিন শত পাউণ্ড আন্দাজ জমা আছে , পরলোকগতা ওলি বুল পত্নীর সম্পত্তির মধ্যে আমার যে সাতশত পাউণ্ড আছে এবং আমার যাবতীয় পুস্তকের বিক্রয়লব্ধ আয় ও তাদের মধ্যে যে গুলোর গ্রন্থস্বত্ব আমার আছে , সেই সকল আমি বেলুড়ের বিবেকানন্দ স্বামীজির মঠের ট্রাস্টিদের দিচ্ছি | তাঁরা ঐ অর্থ চিরস্থায়ী ফাণ্ডরূপে জমা রাখবেন এবং ভারতীয় নারীদের মধ্যে জাতীয় প্রণালীতে জাতীয় শিক্ষা প্রচলনের জন্য তাঁরা মিস ক্রিস্টিন গ্রিনস্টাইডেলের পরামর্শমত তার আয়মাত্র ঐ উদ্দেশ্যে ব্যয় করবেন |

১৫
সর্বশেষে বলি , শিক্ষাকার্যে উৎসর্গীকৃত তাঁর তপস্যাময় জীবন | বাগবাজারের গলির মধ্যে যে ছোট্ট বাড়িতে নিবেদিতা থাকতেন সেখানে বিদ্যুৎ তো দূরের কথা , একখানি টানা পাখাও ছিল না | অনেকদিন অর্ধাশন স্বীকার করেছেন , গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে কত রাত্রি বীতনিদ্র কেটেছে তবু ডাক্তার , শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরোধেও সে বাড়ি পরিত্যাগ করেন নাই | স্বামীজি যে কাজের জন্য নিবেদিতাকে আহ্বান জানিয়েছিল নিবেদিতা আমৃত্যু সেই আহ্বানকে অন্তরে মন্ত্রের মতো জপ করে গেছেন |ব্যর্থতা বা সফলতা যাহা আসে আসুক , জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যেন বিশ্বস্ততার সহিত স্বামীজির কর্ম করিয়া যাইতে পারি – ইহাই ছিল নিবেদিতার একমাত্র প্রাণের বাসনা |” ১৬
—————————————————————
১| ভগিনী নিবেদিতা , প্রবাজিকা মুক্তিপ্রাণা ,সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল , মে ২০১২ , পৃঃ ১৪৫ | ২| স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা সপ্তম খণ্ড , ডিসেম্বর ১৯৯৯ , ৩৬০ নং পত্র , পৃঃ ২৯২ | ৩| ঐ , পৃঃ ২৯২ | ৪| ভগিনী নিবেদিতা , পৃঃ ১১৭ | ৫| ভগিনী নিবেদিতা , পৃঃ ২৪৫-২৪৬ | ৬| নিবেদিতা ও বালিকা বিদ্যালয় ( প্রবন্ধ ) , প্রব্রাজিকা অখিলেশ প্রাণা | ৭| নিবেদিতা স্মৃতি , সাহিত্যম , ১লা ফাল্গুন ১৪০০ | পৃঃ ৬২ | ৮| ঐ , পৃঃ ৬২-৬৩ | ৯| ভগিনী নিবেদিতা , পৃঃ ১৪৭ | ১০| ঐ , পৃঃ ২৫০ | ১১| নিবেদিতা স্মৃতি , পৃঃ ১৭১ | ১২| ঐ , পৃঃ ১৭২ | ১৩| ঐ পৃঃ ১৭৩ | ১৪| ঐ, পৃঃ ১৭৩ | ১৫| নিবেদিতা ও বালিকা বিদ্যালয় , প্রব্রাজিকা অখিলেশ প্রাণা ( প্রবন্ধ ) | ১৬| ভগিনী নিবেদিতা , পৃঃ ২৫৩ |

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।