কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ৮)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ
প্রথমে ২টি পরে ১০টি চারণদল গঠিত হল।চারণদল শুধু দেশের মধ্যে নয়, দেশের বাইরে ইংল্যান্ড, কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ,আমেরিকা, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, চিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলস, প্রভৃতি দেশে প্রচার কার্য চালাতে থাকল। চারণ দলের অবদান বলতে গিয়ে স্বামী বেদানন্দ লিখলেন : “একমাত্র চারণদলের মধ্য দিয়াই আচার্য্যদেব- সন্ন্যাসী ও ত্যাগী কর্মীগণের জীবন গঠন, ধর্মভাব বিস্তার, আদর্শ প্রচার, কর্ম্মিগণের কর্ম্মজীবনের প্রবাহ রক্ষা, অর্থসংগ্রহ,জনসাধারণের সহিত সঙ্ঘের অবিচ্ছেদ্য সংস্রব স্থাপন প্রভৃতি বহু উদ্দেশ্য সাধন করিয়া গিয়াছেন।১৬
চারণদলের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং আচার্য্যদেব। “এই চরণদলই সঙ্ঘের জীবন, সঙ্ঘ আজ এত বিস্তৃত প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ও জনপ্রিয়-তার একমাত্র কারণ এই , procession party; ইহাকে বাদ দিলে সঙ্ঘ একদিনেই প্রাণহীন হয়ে পড়বে।” ১৭
।।তীর্থসংস্কার আন্দোলন।।
তীর্থস্থানগুলি হল হিন্দুজাতির কাছে এক পবিত্র ধর্মক্ষেত্র। ভগবান সর্বব্যাপী হলেও তীর্থস্থানে তাঁর প্রকাশ বেশি। যেমন সূর্য সর্বত্র কিরণ দিলেও আয়না বা জলে তার বেশি প্রকাশ। কিন্তু এক শ্রেণীর লোভী, স্বার্থপর কিছু পুরোহিত বা পান্ডার জন্য তীর্থস্থানগুলি কলুষিত হয়ে পড়ে। ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। এইরকম এক পরিস্থিতিতে আচার্যদেব উচ্চারণ করলেন : “তীর্থসংস্কার হবে আমার ভবিষ্যৎ সঙ্ঘকর্মচক্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদক্ষেপ।”১৮গয়াতীর্থের সংস্কার দিয়েই আচার্যদেবের তীর্থ সংস্কার কাজের শুরু।
ঘটনাটি এইরকম- ১৯১৩। আচার্যদেব উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে মহাত্মা গম্ভীরনাথজীর নিকট দীক্ষাগ্রহণের পর বাজিতপুরে ফিরছেন। তখন পিতা বিষ্ণুচরণ ভুঁইয়া স্বর্গতঃ হয়েছেন। স্বর্গতঃ পিতার পিণ্ড দানের উদ্দেশ্যে গয়া স্টেশনে নামলেন। এবং লক্ষ করলেন কয়েকজন পান্ডা নিরীহ তীর্থযাত্রীদের উপর জুলুম ও লাঞ্ছনা করছেন। এগিয়ে গেলেন তিনি। তাঁর হৃষ্টপুষ্ট চেহারা ও শারীরিক শক্তি দেখে পান্ডারা পিছু হটলেন। তখনই আচার্যদেবের মনে সঙ্কল্প জেগে উঠল – “ভবিষ্যতে আমি যখন দেশ-হিতকর জনসেবার কাজ করব, তখন এই গয়াতীর্থের সংস্কার হবে আমার অন্যতম প্রধান কাজ।”১৯
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে গয়াতে যাত্রীদের উপর পাণ্ডাদের অত্যাচার চরমে উঠল। অত্যাচারের কুফল হিসাবে নবদ্বীপের জনৈক ভদ্রমহিলা নিহত হলেন। স্থানীয় রায়বাহাদুর পূর্ণচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে Bengali Settlers’ Association পক্ষ থেকে এ অত্যাচারের কাহিনীসকল সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হল। এবং প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের নিকট আবেদন রাখা হল। আচার্যদেব যেন এইরকম একটি আহ্বানের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি সংবাদটি পেয়ে কয়েকজন সন্ন্যাসী ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গয়াধামে উপস্থিত হলেন। তারকেশ্বরে মহন্তের বিরুদ্ধে তিনি সক্রিয় আন্দোলনের পথে গেলেন না। আচার্যদেব প্রজ্ঞাবলে বুঝতে পারলেন বিবাদ ও বিরোধের মধ্যে দিয়ে এর সমাধান সম্ভব নয়।
সহৃদয় স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় একটি ভাড়াবাড়িতে তিনি স্থাপন করলেন গয়া সেবাশ্রম। গয়া থেকেই হলো তীর্থসংস্কার আন্দোলনের শুভারম্ভ। বাঙালি হিন্দুরা তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য গয়াধামে যান পিন্ডদানের উদ্দেশ্যে। আচার্যদের এখান থেকেই শুরু করলেন তাঁর প্রথম তীর্থসংস্কার আন্দোলন। তিনি মনে করতেন : “তীর্থক্ষেত্র হচ্ছে জাতির ও সমাজের হৃৎপিণ্ড স্বরূপ। মনুষ্য দেহে হৃদযন্ত্র যেমন বিভিন্ন শিরা-উপশিরার সহায়তায় সর্বাঙ্গে বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে শরীরকে সুস্থ, সবল রাখে, তেমনি তীর্থক্ষেত্র হতে যে পবিত্র ধর্মভাব উৎসাহিত হয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে সমাগত লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর মাধ্যমে সেই ভাবধারা অতি সহজেই সঞ্চারিত হয় সমগ্র সমাজ জাতির জীবনে।”
সেপ্টেম্বর মাসে মহালয়ার পুণ্যতিথিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীদের মধ্যে সেবাকার্য করেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। তিনি কোনোরূপ পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে গেলেন না। যাত্রীদের আশ্রয়দান চিকিৎসাসহ আশ্রমের নিজস্ব পান্ডা দ্বারা স্বল্প খরচে যাত্রীদের তীর্থকৃত্য করার সুযোগ করে দিলেন। মানুষ ভরসা করতে শুরু করল ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের উপর। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই কাশী,পুরী, প্রয়াগধামে সঙ্ঘের নিজস্ব তীর্থসেবাকেন্দ্র ও যাত্রী নিবাস গড়ে উঠল।
বর্তমানে সারা ভারতে বড় বড় তীর্থস্থানগুলিতে গড়ে উঠেছে সঙ্ঘের বিরাট যাত্রী নিবাস ও ধর্মশালা। উত্তরে হরিদ্বার বদ্রীনাথ থেকে শুরু করে দক্ষিণে রামেশ্বরম্ কন্যাকুমারী। এদিকে পূর্বে কামরূপ কামাক্ষা থেকে পশ্চিমের দ্বারকা সোমনাথ পর্যন্ত সঙ্ঘের আশ্রয়ে নিরাপদে থেকে স্বল্পব্যয়ে তীর্থকার্য সম্পাদন করা সম্ভব।
তিনি কোনরূপ রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারে কাছেও না গিয়ে তীর্থস্থানের সংস্কার আন্দোলন সফল ভাবে করতে পারলেন। অবশ্য বাঁধা যে আসেনি এমনটা নয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পান্ডারা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে উঠল। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের জন্য তাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এই অজুহাতে তারা সঙ্ঘকে বয়কট করার ডাক দিলেন। পান্ডারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের যাত্রীনিবাসে কেউ আশ্রয় গ্রহণ করলে তাদের পিন্ডদানের শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম করার জন্য কোনো পান্ডা যাবে না। এমনকি কোনো পান্ডা যদি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে সাহায্য করে তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বয়ং আচার্যদেব গয়াতে গিয়ে পান্ডাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমাধান সূত্র খোঁজার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পান্ডারা অনড়। তখন আচার্যদেবের অনুরোধে একজন ব্রাহ্মণ পান্ডাদের হুমকি উপেক্ষা করে হিন্দুদের শ্রাদ্ধ পিণ্ডদানাদি কার্যে রাজি হলেন। সঙ্ঘের কর্মী ও সন্ন্যাসীবৃন্দ সমস্ত ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সঙ্ঘনেতার নির্দেশ পালন করলেন। স্থানীয় প্রশাসন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেন। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় পান্ডারা পূর্বের মতোই আপস করতে বাধ্য হলেন।
তীর্থক্ষেত্র নিয়ে আচার্যদেবের এত আগ্রহী হওয়ার কারণ তিনি মনে করতেন, “তীর্থ ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলে তা অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে দেশ ও জাতির সর্বস্তরে।” দুর্নীতিগ্রস্ত মোহন্ত পান্ডাকে সরিয়ে দিলেই সব সমাধান হয়ে যাবে না। কারণ যিনি ওই পদে বসবেন তিনিও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে তীর্থযাত্রীদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ পিন্ডাদিদানের সুব্যবস্থা করা।
(ক্রমশ)