সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ১৯

মর্তকায়ার অন্তরালে

|| ১৯ ||
ধর্ম বলতে বিবেকানন্দ কী বুঝতেন

ভক্ত পরিবৃত হয়ে ঠাকুর বসে আছেন | প্রসঙ্গক্রমে বৈষ্ণব ধর্মের কথা উঠল | ঠাকুর বললেন :”ঐ মতে আছে নামে রুচি, জীবে দয়া, বৈষ্ণব পূজন |” কিন্তু জীবে দয়া উচ্চারণ করেই ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন | অর্ধবাহ্য দশায় উচ্চারণ করলেন, “জীবে দয়া- জীবে দয়া? দূর শালা ! কীটানুকীট তুই জীবকে দয়া করবি? দয়া করবার তুই কে? না, না, জীবে দয়া নয়- শিবজ্ঞানে জীবের সেবা |”১নরেন্দ্রনাথ দত্ত শুনলেন এবং তাঁর সমগ্র জীবনের উপর রচিত হলো এক ফিলোজফি্ | বাইরে বেরিয়ে এলেন নরেন্দ্রনাথ | উচ্চারণ করলেন, “কি অদ্ভুত আলোকই আজ ঠাকুরের কথায় দেখিতে পাইলাম ……ভগবান যদি কখনও দিন দেন তো আজি যাহা শুনিলাম এই অদ্ভুত সত্য সংসারে সর্বত্র প্রচার করিব – পণ্ডিত, মূর্খ, ধনী, দরিদ্র,ব্রাহ্মণ,চণ্ডাল সকলকে শুনাইয়া মোহিত করিব |”২

ঠাকুরের কথায় স্বামীজির কী দার্শনিক তত্ত্বের উপলব্ধি হলো? উপলব্ধি হলো – সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাহ্মঃ সহস্রপাৎ- practical Vedanta . স্বামীজি সম্ভব করলেন শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদকে মানুষের ঘরের দ্বারে নিয়ে আসতে-
“ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু সর্বভূতে সেই প্রেমময়
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়|
বহুরূপে সম্মুখে তোমার,ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর |”

স্বামীজির কাছে মানুষই ছিল জ্যান্ত ভগবান | এক সময় মানুষের সেবার জন্য স্বপ্নের বেলুড় মঠ বিক্রি করতে চেয়েছিলেন | নিজেকে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ বলে নির্দেশ করেছেন | স্বামীজি চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ পবিত্র ও সর্বোপরি অকপট মানুষ | “আমি চাই এমন লোক- যাদের পেশী লৌহের ন্যায় দৃঢ় ও স্নায়ু ইস্পাত নির্মিত, আর তার মধ্যে থাকবে এমন একটি মন, যা বজ্রের উপাদানে গঠিত | বীর্য, মনুষ্যত্ব- ক্ষাত্র বীর্য, ব্রহ্মতেজ |”৩

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি বেলুড় মঠে স্বামীজির জন্মোৎসব সভায় ভগিনী নিবেদিতা তাঁর ভাষণে বলেন : “তাঁহার কী শিক্ষা ছিল? তিনি কি চাহিতেন, তাঁহার নাম লোকে গান করুক? না, আমরা জানি তিনি নাম-যশ প্রাণের সহিত ঘৃণা করিতেন | তিনি কি চাহিতেন তাঁহার গুরু শ্রী রামকৃষ্ণের নাম চতুর্দিকে প্রচারিত হউক? না, তিনি তাহাও চাহিতেন না, তিনি কি চাহিতেন, তাঁহার বিশেষ উপদেশ বা কার্যপ্রণালী সকলে অনুসরণ করুক? না, তিনি তাহাও চাহিতেন না | তবে তিনি চাহিতেন কী ? তিনি চাহিতেন, সকলে নিজের পায়ে দাঁড়াক, মানুষ হউক |”৫

ভগবানের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ হলো মানুষ | তিনি মানুষকে পুজো করার কথা বলেছেন | এই পুজোকে তিনি মুক্তির দ্বার বলেও নির্দেশ করেছেন | “কতকগুলো লোক যে দুঃখ দারিদ্রে কষ্ট পাচ্ছে, তা তোমার আমার মুক্তির জন্য – যাতে আমরা রুগী, পাগল,কুষ্ঠী, পাপী প্রভৃতি রূপধারী প্রভুর পুজো করতে পারি |” ৭

মানুষকে পূজা করা, মানুষকে এমনি করে ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্ত স্বামী বিবেকানন্দ | পরিব্রাজন কালে আবু রোড়ে গুরুভাই তুরীয়ানন্দকে বলছিলেন : “হরিভাই, আমি এখনও তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না |…. কিন্তু আমার হৃদয় খুব বেড়ে গেছে এবং আমি অপরের ব্যথা বোধ করতে শিখেছি | বিশ্বাস করো,আমার তীব্র দুঃখবোধ জেগেছে !”৮ তুরীয়ানন্দ স্তম্ভিত | তাঁর মনে হলো- “বুদ্ধও কি ঠিক এমনিভাবে অনুভব করেননি, আর এমনি কথা বলেননি? …..আমি যেন ঠিক দেখছিলাম যে, জগতের দুঃখে স্বামীজির হৃদয় তোলপাড় হচ্ছে – তাঁর হৃদয়টা যেন তখন একটা প্রকাণ্ড কড়াই, যাতে জগতের সমস্ত দুঃখকে রেঁধে একটা প্রতিষেধক মলম তৈরি করা হচ্ছিল |”৯হৃদয়ের এ’রূপ প্রসারতার মধ্যেই ধর্মের সারতত্ত্ব নিহিত আছে |

মানুষকে ভালোবেসে স্বামীজির এমন অবস্থা হয়েছিল যে, মানুষের শরীরের স্থূল দুঃখবোধটাও ঠিক ঠিক অনুভব করতেন | এক ভুটিয়া রমণী পিঠে ভারী বোঝা নিয়ে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় | এটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজি চিৎকার করে উঠলেন | যন্ত্রণা অনুভব করলেন | স্বামীজিকে এই যন্ত্রণার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলো | উত্তরে তিনি শরীরের একটা স্থান নির্দেশ করে বললেন : “এইখানে, তোরা দেখিসনি, মেয়েটা পড়ে গেল |”১০ এমনটা দেখা গিয়েছিল তাঁর গুরুদেব শ্রী রামকৃষ্ণদেবের জীবনেও | গঙ্গাবক্ষে কলহমান এক মাঝির আরেক মাঝির পিঠে চপেটাঘাতের সুস্পষ্ট চিহ্নটুকু ঠাকুরের শরীরে ফুটে ওঠে |

স্বামীজি চাইতেন তাঁর অন্তরঙ্গ প্রাণাপ্রিয় শিষ্যগণ সেই অদ্বৈতানুভূতির স্বাদ উপলব্ধি করুক | অদ্বৈত ভূমিতে ওটার অর্থ – সর্বজীবে সেই প্রেমময়ের অবস্থান হেতু সর্বজীবে সেবা | শ্রী শ্রী মায়ের কথায় : “আমার মাঝে যিনি, তোমার মাঝেও তিনি, দুলে-বাগদি-ডোমের মাঝেও তিনি |”১১
ক্রমশ…….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।