হৈচৈ গল্পে লিপিকা ঘোষ

আবার ছোটুদা

এতদিন সবাই জানত ছোটুদা থার্ড ইয়ারে পড়ে।  কিন্তু  এখন সবাই জেনে গেল যে, সে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। গত ছ’ বছর ধরে উচ্চ মাধ্যমিক ফেল করার কথা গোপন রেখেছিল নিজেই,পাশ করার পর ছোটুদার আবেগ ঠেকানো দায়, ‘আমাদের ফার্স্ট ইয়ার’,’আমাদের ফার্স্ট ইয়ার’, করে সবাইকে জানিয়ে দিল যে সে এবার পাশ করেছে। অথচ ছোটুদা বরাবরই কলেজে আসে, এমন নয় যে অনেক দিন পর কলেজে আসছে। কিন্তু হঠাৎ হাবভাবে পরিবর্তন এসে গেল। ছোটুদা ফার্স্ট ইয়ারে উঠেই সাজগোজে মন দিল। সব সময় ইস্ত্রি করা শার্ট পরতে লাগল,গায়ে বডি স্প্রে মাখতে শুরু করল। সন্ধ্যে বেলায় মাথায় হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে চুল সেট করতে লাগল, মেয়েদের মত ফেসিয়াল করতে লাগল।  এ ব্যাপারে হোস্টেলে ওর একমাত্র সঙ্গী ছিল চাকমা। চাকমার আসল নাম বিমল, এবার আমাদের কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। নাগাল্যান্ড থেকে এসেছে। নাগাল্যান্ডে নাগা, চাকমা সম্প্রদায়রা থাকে। ও তো চাকমা সম্প্রদায়ের তাই ওকে সবাই চাকমা বলে !  চাকমার ছোটুদার সঙ্গে খুব মিল। বেশির ভাগ সময় ছোটুদা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি আর ইংরাজিতে কথা বলে ,আমরাও অবশ্য ওর সঙ্গে তাই বলি। চাকমা মন দিয়ে বাংলা বোঝার চেষ্টা করে।  চাকমা স্বভাবে শান্ত ,কম কথা বলে। কিন্তু  ছোটুদা তো দুরন্ত, কী করে মিল হল কে জানে ! হ্যাঁ, ঐ রূপচর্চায় খুব মিল।
সেদিন টিফিনে কলেজে এক বিপত্তি বাধল। একটা ষাঁড় কলেজের বাউন্ডারির মধ্যে ঠুকে পড়েছে। তাই দেখে সবাই ভয়ে চিৎকার আর ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ষাঁড়ও রেগে গিয়ে ছোটা ছুটি করতে লাগল। বিল্ডিং -এর দরজা জানালা শিং দিয়ে ভেঙ্গে দিতে লাগল। গেট ম্যান বাঁশ নিয়ে তাড়া করতেই ষাঁড় উল্টে তেড়ে গেল। গেটম্যান দিশা না পেয়ে এক ছুটে মেয়েদের কমন রুমে গিয়ে ঢুকল। সেকেন্ড ইয়ারের রফিকুল কলেজে ঢুকছিল, এসব দেখে সামনের বকুল গাছে উঠে পড়ল। ছোটুদা হঠাৎ পিছন থেকে ছুটে গিয়ে ষাঁড়ের লেজ ধরে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে পিঠে উঠে পড়ল। ষাঁড় ছোটুদাকে ফেলে দেবার চেষ্টা করল, ছোটুদা ষাঁড়ের কুঁজ ধরে পিঠের ওপর শুয়ে রইলো। এবার ছোটুদাকে পিঠে নিয়ে আস্তে আস্তে গরুটা শান্ত হল। অন্য গেটম্যান ততক্ষণে ‘লন’ থেকে ক’টা ঘাস এনে  মুখের সামনে ধরল। এবারে ষাঁড়টাকে গেটের বাইরে বের করা গেল। আমি, ভোলা আর ছোলা রুদ্ধশ্বাস এই দৃশ্য দোতালা থেকে দেখলাম।
ছোটুদা ফেব্রুয়ারি মাসটা খুব ব্যস্ত থাকে।  ইউনিয়নের ছেলেদের সঙ্গে সারাক্ষন মিটিং করে। পর পর কতগুলো বড় কাজ তুলতে হয় যে -সরস্বতী পুজো , পিকনিক,  স্পোর্টস, তারপর ভোট। ছোটুদা এই সময় খুব সিরিয়াস হয়ে যায়, নেতা নেতা ভাব চলে আসে, আসলে কলেজের সব নেতাদের থেকে ছোটুদা সিনিয়ার, সবাই ছোটুদাকে মানে, ছোটুদার ওপর দায়িত্ব থাকে সবচেয়ে বেশি।  আমাদের খ্রিস্টান কলেজ বলে গেটের বাইরে ছোট করে সরস্বতী পুজো হয় । তাই পুজো নিয়ে বেশি চাপ নেই। পুজো অবশ্য  আমিই করি, ছোটুদার আদেশে !
প্রতিবার সরস্বতী পুজোর পর পরই পিকনিক হয়। এবারও হবে বলে মেনু ঠিক হল। কিন্তু
এবার কলেজ পিকনিকে কেউ যেতে চায়ছে না। গতবার পিকনিকে মাংস রেঁধেছিল আম আদা দিয়ে, মুখে দেওয়া যায় নি। বাদুর আম বাগানে নাকি আম আদার চাষ হয় ! দেখে আদা গাছ মনে হচ্ছিল। ছোটুদা আদা ভেবে তুলে এনে  ‘অরগ্যানিক’ আদা বলে মাংসে দিতে বলল। ব্যাস, আর সে মুখে দেওয়া গেল না ! শেষে ‘রাঁধুনি কেন বুঝতে পারেনি’ আর ‘ছোটুদা কেন দিতে বলেছে’ এই নিয়ে তর্ক বাধল। তবে এবার ছোটুদা ঠিক পটিয়ে পাঠিয়ে গোটা সত্তর জনকে নিয়ে বাস ভাড়া করে পিকনিকে চলল। আমি, ভোলা, ছোলা কেউই যাই নি। যাবার সময় আমাকে বলে গেল
 -ঝোলা, তোদের তিন জনকে এসে দেখে নেব !
পিকনিকের এক সপ্তাহ পর স্পোর্টস্ শুরু হওয়ার কথা। আগের দিন ছোটুদা এসে আমাকে  বলল
-ঝোলা, ভোলা আর ছোলাকে নিয়ে ভোর বেলা মাঠে চলে যাবি। মাঠে চুন টানতে হবে। এটা তোদের পিকনিকে না যাবার শাস্তি।  অগত্যা পরের দিন ভোরে উঠে মাঠে ছুটলাম।
 নামেই কলেজের স্পোর্টস্, আয়োজন করে ইউনিয়ন থেকে। ইউনিয়ন তো বরাবরই ছোটুদার পার্টির। ভোর থেকে ইউনিয়নের ছেলেদের সঙ্গে চুন টেনে ট্র্যাক কাটলাম।
ন টায় খেলা শুরু হল। ছোলা রানে আগের দুবার ফার্স্ট হয়েছে, এবারও নাম দিয়েছে। আমি আর ভোলা ছোলার ট্র্যাকের কাছেই ছিলাম। একটার দিকে টিফিনে হঠাৎ খেলার মাঠের পাশে তুমুল গণ্ডগোল শুরু হল। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা নাকি ছাত্র সংসদের ছেলেদের মেরেছে। ছাত্র ইউনিয়ন ছোটুদার পার্টি, শুনেই ছোটুদা দৌড়াল। আমরাও ছুটলাম। গিয়ে দেখি ছাত্র ইউনিয়নের সায়নকে কচার বেড়ার উপর ফেলে, কচার ডাল দিয়ে খুব পিটাচ্ছে ছাত্র সংসদের ছেলেরা। আমরা গিয়ে সায়নকে বাঁচালাম। সায়ন নাকি আগে ওদের দুজনকে মেরেছে। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সায়নের সারা গায়ে রক্ত জমে গেছে। ওকে ডাক্তার দেখিয়ে থানায় নিয়ে গেলাম ,কিন্তু রক্ত না বেরলে থানা নাকি কেস নেয় না। তাই কেস করা হল না।
সায়ন আমাদের হোস্টেলের ছেলে, সন্ধ্যে বেলায় ছোটুদা আমাদের সবাইকে ডেকে সায়নের কাছে জানতে চাইল আসল ব্যাপরটা কী হয়েছিল। সায়ন বলল ,ওকে একা পেয়ে ছাত্র সংসদের  কাদের নাকি আগে ওর গায়ে গরম চা ঢেলে দিয়েছিল। সায়ন প্রতিবাদ করতেই ওরা সায়নের ওপর চড়াও হয়। আর ওদের মনোজের কিছুই হয় নি,  আদৌ হাসপাতালে যায় নি।  মিথ্যে কথা রটিয়ে দিয়েছে আর কি। সায়ন মারও খেলো আবার ইউনিয়নের দুর্নামও হল। জানে এসব রোটলে ছোটুদার পার্টি একটা ভোটও পাবে না। চাকমা এতক্ষণ মন দিয়ে সব শুনছিল আর বোঝার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ বলে উঠল -হোয়াট ইজ কচার বেড়া ?
শুনে সবাই  বিরক্ত হল। ছোটুদা আমাকে বলল, -তুই বোঝা।
 আমি বললাম, আমি কচার ইংরাজি জানি না। তুমি বলো। এমনিতেই বিরক্তিকর পরিস্থিতি। তার ওপর ইংরাজিতে কথা বলার ব্যাপার। তবু  ছোটুদা হাত ইশারা করে করে বোঝানোর চেষ্টা করল
-সাম বাম্বু আড়া আড়া ,সাম বাম্বু খাড়া খাড়া, তার মধ্যে কচার গোড়া ,দিস ইস কল কচার বেড়া।
চাকমা কিছুক্ষণ ভেবে বলল -ওহ  আই সি !
ছোটুদা বলল -কী
চাকমা  বলল- বা –ম্বু-উউউ
সবাই হেসে ফেলল ।
এর ক’দিন পরে কলেজে গিয়ে ছোটুদা আমাকে ডেকে বলল -ঝোলা সই কর।
-কিসে?
-ভোটে দাঁড়াতে হবে। এখানে সই কর।
-আমি?কে আমাকে ভোট দেবে?
-তুই ভালো ছেলে , তোকে সবাই দেবে।
জানি ছাড়বে না ,সই করে দিলাম।
ছুটির পর কলেজ থেকে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময় ছাত্র সংসদের আর কাদের এসে বলল,
-তুই ভোটে দাঁড়িয়েছিস?
-হ্যাঁ
– দেখ, তুই ভালো ছেলে, পড়াশনা নিয়ে থাকিস, তুই ওসবের মধ্যে জড়াস না। কে কখন হামলা করবে। দেখলি তো সায়নের কী আবস্থা হল। চল প্রিন্সিপলের ঘরে গিয়ে ‘উইথড্র’ করে আসবি। প্রায় জোড় করে আমাকে নিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে আছি ‘উইথড্রল ফর্ম’এ সই করব বলে, অরন্যদা আর কাদের ভিতরে গেছে। এমন সময় ছোটুদা এসে সব শুনে এক ধমক দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে চলে এল।
ভোটের দুদিন আগে সেকেন্ড পিরিয়োডে কলেজের সামনে হঠাৎ বোম ফাটার শব্দ। গেটের সামনে দুই দলের ছেলেরা মারামারি করছে। দোতলা থেকে দেখলাম, ছোটুদারা কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। অরণ্যদা মোমিনূরকে সামনে পেয়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিল। বেচারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। চুপচাপ থাকে ,কিন্তু ঐ !ছোটুদার ফ্যান ! ছোটুদা গিয়ে কোনো রকমে মোমিনূরকে ছাড়িয়ে আনল। আবার দুটো বোমা ফাটল। এবার গেটের সামনে। চারিদিক ধোঁয়ায় ভরে গেল। প্রিন্সিপল-এর নির্দেশে গেট বন্ধ হল। কলেজের ভিতরে যে যেদিকে পারল পালাল। তখনও সজল আর ছোটুদা গেটের বাইরে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। ছোটুদার চিৎকার শোনা গেল। সজল পালিয়ে যা, গুলি লেগে যাবে।
এর পর সন্ধ্যা বেলায় পুলিশ এলে তবে গেট খোলা হল। ততক্ষণ  হস্টেলে গিয়ে মোমিনূর  আর সজলকে দেখে সস্তি পেলাম। কিন্তু ছোটুদা কোথায়?
ঘন্টা দুয়েক পর ডান হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে ছোটুদা এল। হাতের ওপর দিকে গুলি লেগেছে। পরের দিন কলেজে ঢুকতেই সজল ছোটুদার নামে স্লোগান দিতে শুরু করল। ছোটুদা এক হাত তুলে সবাইকে আস্বস্ত করল।  ছোটুদাকে ঘিরে ধরে সারাক্ষণ আলোচনা চলল। ছাত্র সংসদের ছেলেরা বলেছে তারা নাকি বোমা ফাটায়নি,গুলি করেনি, সিটি কলেজের ছেলেরা করেছে। কিন্তু সিটি কলেজের ছেলেদের কারা ডেকে এনেছে ,তা তো সবাই জানে।
ভোটের দিন ছোটুদা বলে দিয়েছিল-
গিয়ে ভোট দিয়ে চলে আসবি। থাকতে হবে না। হামলা হতে পারে।
কিন্তু সেদিন কলেজে পুলিশ ছিল। কোনও হামলা হয়নি। সন্ধ্যে বেলায় রেজাল্ট বের হল। ছাত্র ইউনিয়নের সব ক্যান্ডিডেট জিতে গেছে। মানে আমিও! রাতে হস্টেলে আনন্দের বন্যা বইল। হস্টেলের সব ছেলেই তো ছোটুদার দলের ! সায়ন এখন পুরোপুরি সুস্থ। ও ছোটুদাকে বলল-
এবার হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্ট হয়ে যাক ! ছোলা বলল-
 আগে ছোটুদার হাতটা ঠিক হয়ে যাক, তারপর। ছোটুদা বলল-
 না না কালকেই হোক, আরে, আমার কিছু হয়েছে নাকি ! ভোটে জিততে গেলে ওরকম ফল্স গুলি খেতে হয়। ওরা সায়নকে ,মোমিনূরকে, আমাকে মেরে ভোটে জিততে চেয়েছিল, আমি কাউকে না মেরে ভোটে জিতেছি।
 ভোলা বলল,-তোমার গুলি লাগেনি? তাহলে এ ব্যান্ডেজ?
-ও তো চাকমা করে দিয়েছে, কলেজের পিছনের গলিতে, ওর মামার বাড়িতে বসে -বলে নিজেই ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করল।
সবাই গোল গোল চোখ করে ব্যান্ডেজ খোলা দেখছিল। ভোলার খুব ইচ্ছা হল কেমন করে ব্যান্ডেজ করেছে তা জানবার। এবার  ভোলা চাকমাকে জিজ্জাসা করল- হাউ ইজ ব্যান্ডেজ?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।