মার্গে অনন্য সম্মান খুশী সরকার (সেরার সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৬৮
বিষয় – কুয়াশা/চড়ুইভাতি/নবান্ন

স্বাদ-আহ্লাদে নবান্ন

আজ রণিতার ভীষণ আনন্দ। সকালে উঠেই চা বানিয়ে ভাত বসিয়ে দিয়েছে।চা-এর কাপ হাতে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দরজার দিকে তাকাতেই কড়া নাড়ার আওয়াজ, “বৌদি, ও বৌদি, দরজাটা খোলো” চা-টা টেবিলের উপর রেখে দরজা খুলেই রণিতা বলে, এই তো তোর তাড়াতাড়ি?কত করে বলে দিলাম, কাল একটু আগে আসিস। সেই আসলি এক‌ই সময়ে।নে, তাড়াতাড়ি করে বাসনগুলো মেজে দে।তরুর আওয়াজে টিয়ার ঘুম ভেঙে যায়।দিলে তো তোমরা ঘুম ভাঙিয়ে।টিয়ার গলায় বিরক্তিরসুর।
ও সোনা,উঠে পড়ো।
“আরেকটু ঘুমাবো মা”
না বাবা, দেরি হয়ে যাবে তো।
“কেন মা” জানতে চায় টিয়া।
“আজকে আমরা মামা বাড়ি যাব তো” সোনা। মামার বাড়িতে কাল নবান্ন না, উৎসাহভরে বলে রণিতা।
“ও তাই” কপালে চোখ টিয়ার।
“আমরা খুব মজা করবো কাল।”
ও মা,নবান্ন কী?
নবান্ন? নবান্ন মানে নতুন চালের ভাত খাওয়া।
আমরা রোজই তো ভাত খাই, কই তেমন আনন্দ হয় না তো?
ওরে বোকা, সেদিন সবাই মিলে খুব আনন্দ করে প্রথম নতুন চালের ভাত খাওয়া হয়, ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া হয়, বাড়িঘর সুন্দর করে লেপে-পোছে আল্পনা দেয়া হয়। উঠোনে বসে ঠাকুরের দেওয়া প্রসাদ প্রথমে সবাই একসঙ্গে খায়। চল্ না, দেখবি কত মজা হয়!
তোকে এক বছরের নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম সেই নবান্নে। খুব মজা হয়েছিল। তারপর তো কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বছর আর যেতে পারলাম না। কিছুদিন পরেই তোর বাবা এমন অসুস্থ হলো—-
কিছুক্ষণ থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রণিতা। তারপর ঠাকুরের নামে হাত জোর করে প্রণাম করে বলে,যাক ঠাকুরের দয়ায় এখন সুস্থ হয়েছে। এই আমার চরম পাওয়া।
ওমা, কি বলছো? হাতে ব্রাশ নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে জিজ্ঞেস করে টিয়া।
মুখ ফিরিয়ে রণিতা বলে,”না না কিছু না। নাও মা, তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নাও, কমপ্লেন আর বিস্কুট খেতে হবে না? তারপর বাবা অফিসে গেলেই আমরা যাবো মামার বাড়ি” বলেই তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয় আর নিজে নিজে বলে জলপাইগুড়ি তো আর কম দূরে না! যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যাই হয়ে যাবে।
বাবা যাবে না, মা?
“যাবে তো, সোনা” অফিস করে যাবে।
“আমরা কিসে যাবো?”
“স্টেট গাড়িতে”।
আনন্দে হাততালি দিতে দিতে টিয়া বলে, “কি মজা, কি মজা, আমরা মামা বাড়ি যাবো, নবান্ন খাবো।”
মেয়ের আনন্দ দেখে বুক ভরে যায় রণিতার। সমস্ত গোছগাছ করতে করতে দেখে অমিত স্নান সেরে খাওয়ার টেবিলে বসেছে।। রনিতা তখন তাড়াতাড়ি ভাতের থালা সামনে দিচ্ছে এমন সময় তরু উঠোন থেকে ডেকে বলে, “আমি আসছি বৌদি, আমার সব হয়ে গেছে।” অমনি পিছন ফিরে রণিতা বলে,”আমি চার দিন থাকবো না, এই কয়দিন তুই আসিস না, কেমন। সোমবারে কিন্তু খুব সকালে আসবি, দাদাকে অফিসের ভাত দিতে হবে বুঝলি?”
হুম্, আচ্ছা—বলে চলে যায় তরু।
“তুমি কিন্তু অফিসে ম্যানেজ করে তাড়াতাড়ি রওনা দিও, নাহলে অনেক রাত হয়ে যাবে” অমিতের উদ্দেশ্যে বলে রণিতা।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি ঠিক চলে যাবো। আমাকে নিয়ে ভেবো না।”
“না না, তুমি আবার গল্প করতে করতে সময়ের কথা ভুলে যাও তো, তাই মনে করিয়ে দিলাম। জানোই তো, রাত্রে ওদিকে তেমন গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যায় না,
“ঠিক আছে, তোমরা সাবধানে যেও।” অফিসে বেরিয়ে যায় অমিত। আধঘন্টার মধ্যে ভাত খেয়ে ঘর দোর বন্ধ করে মা-মেয়ে র‌ওনা দেয়। ধুপগুড়ি ব্রিজের কাছে নেমে ওখান থেকে ভ্যান রিকশায় পৌঁছে যায় বাপের বাড়ি প্রায় আটটা নাগাদ। মেয়ে-নাতনিকে দেখে সুশীল বাবু আর সুরমা দেবীর ভীষণ আনন্দ। বিশেষ করে নাতনিকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করে। মামা-মামিও বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। রাঙা মাসি, ছোট মাসি, বুবাইদা, টুবাইদা, টুসি সবাইকে দেখে টিয়া আনন্দে আটখানা। এখানে এসেছিল আগে মায়ের সঙ্গে কিন্তু নবান্নে এই তার প্রথম আসা।
টিয়াকে পেয়ে ওরাও খুব খুশি। তারপর রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। টিয়া খুব ভোরে উঠবে বলে শুয়ে পড়ে কিন্তু চোখে ঘুম নেই তার।সে আনন্দে আত্মহারা, কখন সকাল হবে,কখন নবান্ন হবে,নবান্ন কেমন —খুব কৌতুহল তার।

নির্ঘুম চোখে নবান্নের কত না ছবি আঁকতে আঁকতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে হঠাৎ মাসতুতো, মামাতো ভাই-বোনদের আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় টিয়ার। ঝট করে উঠেই বাইরে এসে দেখে কি সুন্দর গোবর নিকানো উঠোন ঝা-চকচকে! রাঙামাসি আলপনা দিচ্ছে সুন্দর সুন্দর ফুল পাতা এঁকে।খামারে ধান থৈ থৈ। গরুগুলো আয়েশ করে চিবোচ্ছে নতুন ধানের খড়।
“ওরে তোরা এক এক করে স্নান কর”–বড় মামির ডাক শুনে টিয়া দৌড়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে মা,ছোটো মাসির স্নান হয়ে গেছে। মা’কে ভিজে দেখে বলে,ওমা এখনি স্নান করবো?
হ্যাঁ মা, এখনই। দাদারাও স্নান করবে তো। স্নান না করে ঠাকুরকে দেওয়া নতুন চালের প্রসাদ খেতে নেই। ঠাণ্ডা লাগবে মনে হলেও আনন্দে সবার সঙ্গে টিয়াও স্নান করে। দারুণ আনন্দ অনুভব করে। তারপর ধোয়া জামা কাপড় পরে উঠোনে আলপনার আসনে খড়ের আঁটিতে সবাই বসে পড়ে। ওদিকে একটা পাথরের থালায় আতপ চাল আতপ চিরে কাঁচা দুধ ফলমূল নতুন কমলালেবু বাতাসা নলেন গুড় বরবটি চিনি কলা সুন্দর করে সাজিয়ে উপরে তুলসি পাতা দিয়ে ধূপকাঠি,প্রদীপ জ্বেলে পাথরের গ্লাসে জল দিয়ে ঠাকুরকে নিবেদন করে দিদুন মাথায় ঘোমটা টেনে। তারপর ঠাকুরের উদ্দেশ্যে এক এক করে সবাই প্রণাম করে।
“যাও মা, তুমিও প্রণাম করো” দেখো সবাই ওখানে প্রণাম করছে”–রণিতা মেয়েকে ডেকে বলে। টিয়া ওদের মত মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে।তারপরেই দেখে দাদু একটি নতুন খড়ের আঁটিকে অগ্নিকোণে রেখে তার উপরে গোটা কলা দেয়।পান সেজে দেয়। পরে সেই খড়ের আঁটিতে দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালায়।সেই আগুন নিভে গেলে জল ছিটিয়ে সবাই প্রণাম করছে।
অবাক হয়ে দেখে টিয়া। সবার প্রণাম করা হয়ে গেলে দাদুকে জিজ্ঞেস করে, ও দাদু, এখানে আগুন জ্বালালে কেন?
“ও দিদিভাই, তুমি তো দেখোনি, তাই জানো না। এই আগুন ব্রহ্মাকে উৎসর্গ করা হয়। তারপর ভক্তিভরে প্রণাম করতে হয়। তিনি যেন সবাইকে ভালো রাখেন আর অগ্নিতে কোনো ক্ষতি যেন না হয় সে জন্য তাঁকে তুষ্ট করে আশীর্বাদ চাইতে হয়।”
ও-ও,তাই?
হ্যাঁ দিদিভাই, যাও তুমিও প্রণাম করো– সুশীল বাবু টিয়াকে বলেন। এদিকে অধীর হয়ে বাচ্চারা অপেক্ষা করে প্রসাদ পাবার জন্য। তারপর দাদু ধুতির একটা আঁচল গলায় দিয়ে কলাপাতায় প্রসাদ নিয়ে বাইরের দিকে একটা ফাঁকা জায়গায় মাটিতে জল ঢেলে তার উপর সেই কলা পাতায় রাখা প্রসাদ দেয় এবং একটি ধূপকাঠি জ্বেলে জল ছিটিয়ে প্রণাম করে। গাছের দিকে তাকিয়ে কাকেদের ডাক দিয়ে বলে, এসো এসো তোমরা যে যেখানে আছো, আমার পূর্ব পুরুষেরা সবাই নতুন অন্নের প্রসাদ গ্রহণ করো। আজ আমি নতুন অন্ন গ্রহণ করতে চলেছি। তোমরা আশীর্বাদ করো লক্ষ্মী যেন চিরকাল বাঁধা থাকে। তারপর বড়রাও বাচ্চাদের পাশে এক একটা আসনে বসলে সবার সামনে একটা করে কলা পাতা দেয় এবং তার উপরে ঠাকুরকে দেওয়া প্রসাদ অল্প অল্প করে দেয়। সেটা খাওয়া হয়ে গেলে ভাজা চিড়ে, মুলো শশা আদা আর বরবটির শুকনো ঘুগনি।এর পর গামছা বাঁধা মোষের দুধের দ‌ই আর কাচা চিড়ে,গুড়।এই খাওয়া টিয়া কোনোদিন খায়নি। সেই সুস্বাদু দ‌ই-চিড়ে খেয়ে টিয়া স্বাদে-আহ্লাদে আটখানা। খাওয়ার পরে সব ভাইবোন মিলে মা মাসি দাদু দিদুনের সঙ্গে কি মজার গল্প! সবার মুখে হাসি। সবাই যার যার কাজে তৎপর হয়ে আনন্দ-আবেগে হেসে হেসে কাজ করে চলেছে। এতোটুকু ক্লান্তি নেই কারো। তারপর শুরু হয় একসঙ্গে বসে সবজি কাটা। বিশাল মাছ নিয়ে আসে বড় মামা। ছোট মাসি কাটে সেই মাছ। এত বড় মাছ কাটতে দেখেনি টিয়া কোনোদিন। মাসির কাছে বসে একভাবে দেখে সেই মাছ কাটা। তারপর ধোয়া। এইবার শুরু রান্না। মাটির উনুনে চড়ে রান্না। কেউ রাঁধে, কেউ যোগান দেয়, আবার কেউ বাটনা বাটে। “নয় ব্যঞ্জনে নাকি নবান্ন” রাঙামাসির কাছে এই কথা শুনে টিয়ার ভীষণ মজা হয়। এতগুলো পদ দিয়ে কিভাবে সে ভাত খাবে, ভেবে কুল পায় না। এত আনন্দ জীবনে সে কোথাও পাইনি। সত্যি নবান্ন এমন হয় ভাবতে সে যেন পুলকিত হয়ে দৌড়ে যায় কখনো দিদুনের কাছে, কখনো বাবার কাছে, কখনো মামার কাছে। আজ তার মজাই মজা।
সন্ধ্যার পরে শুরু হয় উঠোন বসে ভাত খাওয়া।ছোটো মামা ত্রিপল টাঙিয়ে দেয় উঠোনের উপর।ছোটো মামি পাড়ার লোকেদের ডেকে আনে।
মা-মাসি-মামি সবাই পরিবেশন করছে। অনেক পদের তরকারি দেখে টিয়ার চোখ ছানাবড়া।কোনটা খাবে আর কোনটা রাখবে?
এমন সময় কয়েকজন বাচ্চা ছেঁড়া নোংরা জামা প্যান্ট পরে এসে দাঁড়ায় দরজায়। ওদের মধ্যে বড় ছেলেটা কাতর স্বরে বলে,ওমা, আমাদের খেতে দাও না গো। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আমাদের আজ খাওয়া জোটেনি। ওদের দেখে টিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
“ওরা খেতে পায়না কেন” মা’কে জিজ্ঞেস করে টিয়া। “ওরা গরিব তো”
“আমাদের তো অনেক খাবার, দাও না খেতে ওদের?”
“দেবো তো”
“আমাদের সঙ্গেই দাও না মা?”
” ঠিক আছে সোনা, তুমি খাও, ওদের এখানে দিচ্ছি”
পাশ থেকে ছোটো মাসি বলে।
“না না মাসি, আমাদের সঙ্গে এই লাইনেই দাও”
শেষে টিয়ার জেদে ওদের লাইনেই শেষের দিকে দেয়া হয়, সবাই মিলে খাচ্ছে।
“আমি এত খেতে পারবো না,মা।”ভ্রুকুচকে বলে টিয়া।
“রেখে দে পাতায়”
মায়ের কথা শুনে হঠাৎ করে পাতার সব তুলে দেয় ওদের পাতায়।
“একি করছিস তুই!”
“আমি তো রোজ খাই মা,তাই আমারটা আজ ওদের দিলাম।
ওর কথা শুনে সবাই ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।