“যখন ডাকি শিউলি হয়ে,শরৎ তখন,
ভোরের হাওয়ায় বলে…
কান্না রাখিস না,মা তো ছিলই মা তো আছেই,
সবখানেতেই মা,যখন ডাকি মা।
সহস্র চোখ,বিপন্ন মুখ দুহাত তুলে বলে,
বাইরে খুঁজিস না।
ব্যর্থ জীবন, ক্লান্ত জীবন পাশেই আছে মা।
মা বললেই স্নেহের সকাল।
মা বললেই তৃষ্ণার জল।
মা বললেই ছায়ার আঁচল।
মা বললেই দুঃখ উধাও…
যখন ডাকি মা।
মন্দিরে আর গীর্জায় কিংবা মসজিদে,
সুর ভাসে একই তো সুর না!
মানুষ বড় কষ্টে আছে,মানুষ বড় দুঃখে বাঁচে,
মানুষ বড় যাঁতাকলে,মানুষ বড় চোখের জলে,
এর নেই কি শান্তনা!
দূরের থেকে মা তখনই উঠে আসেন কাছে।
শীয়রে হাত রেখে বলেন,
আমি আছি না,
যখন ডাকি মা….যখন ডাকি মা।”
(কবি শুভ দাশগুপ্ত)
ফ্যাল্ ফ্যালে ফ্যাকাশে চোখে নির্বাক দৃষ্টি। সময় প্রায় বেলা বারোটা। বারো বাই চোদ্দ ঘরের এক পাশে খাটে শুয়ে এক মা, দুচোখ জুড়ে তার যেনো কিসের প্রতিক্ষা! মেয়ে নাতী-নাতনী নিয়ে ভরা সংসারে বড়ো মেয়ের কাছে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে উনি আছেন। বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। নানান রোগে জর্জরিত কিন্তু বড়োমেয়ে যথাসাধ্য সেবাযত্ন ও আরামদায়ক শুশ্রূষা করে তাঁকে অনেকটাই সুস্থ করে রেখেছে। ছোটোমেয়ে বেশ কাছেই থাকে। সেও মায়ের জন্য যথাসাধ্য করে। যখনই যেটা দরকার হয় বড়দির পরামর্শ মতো মায়ের প্রয়োজনে নিয়ে আসে। আর দূর থেকে তাদের সবার সাথে সহযোগিতা করে বৃদ্ধার মেজোমেয়ে। তবুও উনার যেনো কিসের অভাব, কিসের ঘাটতি… সব থেকেও যেনো সেই মায়ের কি নেই !!
এরইমাঝে প্রায়ই সন্ধ্যের দিকে সেই সুদূর আমেরিকা থেকে বৃদ্ধার মেজোমেয়ে ফোনে ভিডিও কল করে। মাকে নিয়ে তিনবোনে একসাথে কতো গল্প গুজব করে, কতো মজা করে। একটু মাকে অন্যমনস্ক রাখার চেষ্টা আর কি। কতোই বা আর রোগ শোকের কথা বলা যায় !! এখন যতো পারে ওরা মায়ের মনটা অন্যদিকে ফেরাতে চায়। তবু পারেনা। সকলের অলক্ষ্যে একলা বসে নিজের অজান্তেই মায়ের শুকনো গাল বেয়ে টপ্ টপ্ করে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরে, গলা শুকিয়ে আসে। বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে….. কি করে ভুলে যাবেন উনি তাঁর একমাত্র ছেলের কথা !! আজ সশরীরে বিদ্যমান থেকেও যে নেই। কি জানি এর নামই বোধহয় জীবন, এরই নাম সংসার !! আশি বছরের এই বৃদ্ধা গত আট দশ বছরে বুঝে গেছেন, মেনে নিয়েছেন নিয়তির এই চরম পরিহাস। যে কোনো কারণেই হোক তাঁর একমাত্র ছেলে তাঁর প্রতি বিরূপ। সে কারণ আর নাই বা বলা হলো। তবে মা তো মা’ই হয়, শত সন্তান থাকলেও প্রতি সন্তানের প্রতিই মা সমভাবাপন্ন হয়ে থাকেন। পাঁচ আঙুল সমান না হলেও সে তো ওই হাতের চেটোর’ই অংশ। বুকের কলিজার এক একটা টুকরো বুঝি একেকটি সন্তান। কথায় আছে….”কুপুত্র(কুসন্তান) যদিবা হয় কুমাতা কখনো নয়”। কিন্তু মাতা সু নাকি কু সে বিচার কে করবে !! ভগবান এই অভাগী মায়ের জীবনের এটুক ঘাটতি বুঝি এ জনমে আর পূরণ করবেন না।
রাত আট’টা বাজে। ঘরে টিভি চলছে। খবরের থেকে ঘুরিয়ে মেয়ে এবার চ্যানেল ভক্তি গীতিতে রাখলো..কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে জোরে বললো….”কি এটা ঠিক আছে? দেখবে এটা?”। বৃদ্ধা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। গরম গরম ছানা দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছে মেয়ে। একটু বসে নিক তারপর রোজকার নিয়মমাফিক ওষুধ দেওয়া হবে এক এক করে। একটু ঝিমুনি এসেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠলো,আমেরিকা থেকে মেজোমেয়ের ফোন। চলল কথোপকথন। এখন এক গৎবাঁধা জীবন…..জানে এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে। নাতি নাতনী পরিবৃত্ত বড়ো সংসার। তাও তো অন্য অনেকের থেকে কতো ভালো জীবন তাঁর…… ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বৃদ্ধা। স্বামী বেঁচে থাকতে আরেকটু অন্যরকম ছিলো দিনগুলো। উনি তখন নিজে সক্ষম ছিলেন। নিজের হাতে কোনো কোনো দিন সামান্য রাঁধা-বাড়া দেওয়া-থোওয়া এসব করেছেন। আজ সেসব অতীত স্মৃতি। জীবন এখন গুটিয়ে অনেক ছোটো হয়ে এসেছে আর এদিকে রোজকার দিনযাপনের একেকটা দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম হয়ে চলেছে। একেকটা মধ্যাহ্ন, একেকটা রাত যেনো কাটতেই চায় না। তারইমধ্যে ধীরে খুব ধীরে আবছা হয়ে আসতে থাকে একটা কচিপানা মুখ….. যে সর্বক্ষণ মা মা করে পেছু করতো…..তখন বুঝি সে ছেলের বছর পাঁচেক এর মতো বয়স। মা যখন পুজো করতে বসতো, পাশে আসন পেতে বসে থাকতো। ১লা বৈশাখের দিন নিজের হাতে খরগোশ এঁকে সেলাই করে পরিয়ে দেওয়া সাদা ধুতি পাঞ্জাবীতে কি যে অপূর্ব মায়াময় দেখাচ্ছিলো শিশুটিকে! কপাল চুমে মা নজরটিকা এঁকে দিয়েছিলো।
সেদিনের থেকে সময় এগিয়ে আজ প্রায় ষাট বছর পরে তেমনই আরেকটি ১লা বৈশাখ…এর মাঝখানে কেটে গেছে কতোগুলো বছর। আজ কতো আনন্দ কতো হৈচৈ বড়োমেয়ের বাড়িতে। এদিকে নিজের ঘরে জানালার ধারে একলা চুপটি করে বসে মায়ের চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। কোলে ছোট্ট পুরনো একটা এলবাম। কতো কথা….. কতো কথাই না মনে পড়ছে এক এক করে। এমনসময় বাইরে রাস্তায় একটা রিক্সা এসে দাঁড়ালো…..ছোটো মেয়ে এলো। “ওহ্ চোখ’টা এবার শিগগীর মুছে নেই…. আমাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখলে ওদের আরো কষ্ট হবে….ওরাও তো আমার সন্তান। আমাকে একটু ভালো রাখার জন্য রাতদিন ওরা যাথাসাধ্য করছে”..বৃদ্ধা ভাবে মনে মনে। বুকের কষ্ট বুকে চেপে রাখে। দীর্ঘ পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে এমনটা ভালোই অভ্যেস আছে উনার। এ সংসারের জাঁতাকলে পিষে এমন কতো দু:খ মুখ বুঝে সয়ে এসেছেন এতোকাল… এ আর এমন কি?? এজন্যই বলে মা হওয়া কি মুখের কথা !! ‘মায়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’। আমাদের এই মায়ের মতোন এমন আরো কতো অভাগী মা রয়েছেন এ সংসারে তার খোঁজ আমরা কয়জন রাখি!…. কয়জনই বা বুঝি তাদের দু:খ! আমাদের মায়েদের ভগবান পাষান হৃদয় দিয়ে গড়েছেন….তাই তো উনারা এমন পাষাণী।