সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ১২

গল্প নেই – ১২

হঠাৎ মনে পড়ে যায় একটি টিনের বাক্সের কথা। যে বাক্সটির মধ্যে ছিল আমার সাম্রাজ্য। গোছা গোছা নানারকমের সিগারেটের প্যাকেট। ছোটো বড়ো প্রচুর রঙিন কাচ্চিল গুলি। সাদা মার্বেল গুলি। লাট্টু, লেত্তি। ঘুড়ি লাটাই। কত রঙের কাগজ। ঘুড়িতে তাপ্পি দেবার জন্য।  বিসর্জনের আগেই সংগ্রহ করা দেবীর হাতের অস্ত্র। কাগজ থেকে কেটে পরপর সাজিয়ে রাখা গোয়েন্দা রিপের ছবি। জাদুকর ম্যানড্রেক। অরণ্যদেব।  এরকম আরও কতকিছু। আর ছিল কিছু জমানো পয়সা। এতেই আমার মনে হত কি নেই আমার কাছে? কি যে ভালো লাগত তখন ঐ টিনের বাক্সের ভেতরের জিনিসপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে!
একদিন বাক্সটি অভিমানে দূরে চলে গেল। একটু একটু করে উঁচু ক্লাসে উঠছি। বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। বাক্সটির সঙ্গে দেখা হচ্ছে খুব কম। ওটির কাছাকাছি থাকা ক্রিকেট ব্যাট, র‍্যাকেট, ঘুড়ি লাটাই ওসবে এক একটা দিন শেষ হওয়ার ধুলো জমতে শুরু করেছে।
আমার  দিন কাটানোর ধরণ বদলাতে শুরু করল। বদলে গেল মেলামেশার সঙ্গী। একটি বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে যাওয়ার মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আগের অনেক কিছু কম গুরুত্ব পেতে লাগল।
একসময় ভুলে গেলাম ঝাকড় মাকড় চুল ছড়ানো নিজের মুখটিও। মনে হত কেমন যেন অন্যরকম দেখতে হয়ে যাচ্ছি। 
বাসস্থান বদল করতে করতে একদিন খুঁজতে গিয়ে দেখি বাক্সটি নেই। নেই তার আশেপাশে থাকা অন্যান্য খেলার সরঞ্জাম। ওসবে বহুকাল আমারও কোন টান নেই। তাই দেখে হয়তো কেউ জঞ্জাল মনে করে ফেলে দিয়েছে। হয়ত বা ওরাই অভিমান করে আমার চোখের আড়ালে চলে গেছে। জানিনা।
এখনও ওই বাক্সটির কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটায় কেমন মন খারাপের হওয়া তোলপাড় করে যায়। কত যত্নে একদিন রেখেছিলাম ওই বাক্সটির মধ্যে যা কিছু ছিল সব। 
সেটি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাওয়ায় মনে হত সঙ্গে করে নিয়ে গেছে আমার শৈশব। সেই দিনগুলি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে খুব। মনে হয় হাতের মুঠোয় নিয়ে সেই দিনগুলির ঘ্রাণ নিই। জানি যে সময় নির্দেশের কাঁটা ডানদিকে ঘুরে যাচ্ছে অবিরত। হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি পল। তা আর কোনোদিন বাদিকে ঘুরে আসবে না। 
একটা ছুটির দিন বিকেলে পায়চারি করতে বেরিয়ে দেখি ঘুড়ি ওড়াচ্ছে পরিচিত একটি ছেলে। কেমন একটা ইচ্ছেতে হাত এগিয়ে দিতেই ছেলেটি ওর লাটাই তুলে দিল আমার হাতে।
সেই কোন অতীত থেকে চনমনে একটা উৎসাহ এসে দাঁড়াল পাশে। সুতো ছাড়লাম। ঘুড়ি এগিয়ে যাওয়ার পথে দুটি ঘুড়ির সঙ্গে দেখা হল। ওদের ইচ্ছে আমার ঘুড়ির সঙ্গে লড়াই করবার। সহজেই সে দুটোকে ভোকাট্টা করতেই মনে হল আমার শৈশবের সঙ্গীরা যেন হই হই করে উঠল আমার চারপাশে। যেন কতদিন বাদে দেখা হল সবার সঙ্গে।
ওদের হাতে লম্বা লগি। উপরে দড়ি দিয়ে বাঁধা কাঁটাগাছ। যদি সেখানে ঘুড়ি বা সুতো আটকে যায় তবে পাওয়া হয়ে যাবে সাত রাজার সম্পত্তি। ওরা ছুটছে। আমিও ছুটছি। কখনো কোনো রাস্তায়। নয়ত কারও বাড়ির উঠোন পেরিয়ে। কোথায় না কোথায় যাচ্ছি আমরা একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির জন্য।
খালি পায়ে কত আঘাত। কিছু মনেই হচ্ছে না আমাদের। জামার পকেটে ঘুড়ির রঙিন কাগজে বাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা ভাত। যদি ঘুড়ি ছিঁড়ে যায় তবে তাপ্পি দিয়ে নেব। সমস্ত শরীরে ধুলো। এ গলি ও গলি পেরিয়ে হঠাৎ দেখি ঘুড়িটা অনেক উঁচুতে একটা বট গাছের মাথায় আটকে গেল।
এইসব আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠল। ভাবতে ভাবতে আমি এক ঘোরের মধ্যে সুতো ছেড়েই যাচ্ছি। লাটাই থেকে ঘুড়ি অবধি সুতো যেন দোল খেয়ে পড়েছে। একটু একটু করে আলো কমে আসছে। ছোটো দেখাচ্ছে ঘুড়িটাকে।
হঠাৎ একটা মৃদু টান। সুতোর শেষ প্রান্ত আটকে আছে লাটাইয়ে।
লাটাইটা ছেলেটির হাতে দিতে গিয়ে দেখি সে পাশে নেই। ছুটেছে একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছনে।
ঘুড়ি আমাকেই নামাতে হবে! ভেবে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভিড় করল আমার শরীরে। 
ঘুড়িটা ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। হাত কাঁপছে কেন আমার! আমি কি নামিয়ে আনতে পারব ঘুড়িটাকে? একটা ক্লান্তির চাদর যেন আমাকে ঢেকে ফেলল। 
লাটাইয়ে আটকানো সুতো ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম।
আমার শৈশব আবার কোন অজানায় মিলিয়ে গেল। 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।