দোকানের দায়িত্ব পেয়ে প্রথমটা খুব খুশি হয়েছিল নিরাপদ। মেট্রো রেলের মাটি আলগা হয়ে অনেক সোনার দোকানের ও বাড়ির ক্ষতি হলেও ওদেরটা কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছিল। তারপর থেকেই নিরাপদর বাবা গুরুপদর ভাবনা চিন্তা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। তারপরে এল লকডাউন।
গুরুপদর স্থির বিশ্বাস যে সোনার দোকান থেকে আর কিছু হওয়ার নয়। এবার অন্য কিছু করতে হবে। সোনা কিনে গয়না বানিয়ে বিক্রি করে তেমন লাভ থাকে না। দক্ষ কর্মচারিদের লকডাউনে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা কেউ ফিরে আসেনি। নতুন কিছু লোক রাখা হয়েছে। তাদের যা অভিজ্ঞতা তা দিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানো যায় না। অন্যকিছু ভাবতে হবে। দেখা যাক নিরাপদ যদি ওর বুদ্ধি দিয়ে দোকানটাকে আবার চালু করতে পারে! তখন না হয় ভেবে দেখা যাবে।
নিরাপদ বাবার কথা মেনে দোকান খুলছে।
দোকানে বেশকিছু গয়না তৈরি করা ছিল। সেইসব নিরাপদকে বুঝিয়ে গুরুপদ বলেছেন, তাঁর দোকানে আসার সময় হবে না। প্রতি ছ’মাস অন্তর সব হিসাব নেবেন।
নিরাপদ বলেছিল, ‘ছ’মাস কেন বাবা? বছরে একবার হিসেব নিলেই তো হয়। হালখাতার আগে।’
গুরুপদ বলেছিলেন, ‘তোমার হালহকিকত তো আমার জানতে বাকি নেই। কলেজের পাশটাও দিতে পারলে না। আমি হালখাতা অবধি অপেক্ষা করলে তোমার কি সুবিধা হবে জানিনা, তবে আমার দোকানের হাল যে খুব খারাপ হবে তা বেশ বুঝতে পারছি। সব লাটে তুলে দেবে। আমি ছ’মাস অন্তরই হিসেব নেব। তাতে যদি দেখি তুমি ব্যবসা বুঝতে পেরেছ তা হলে দোকান তোমার নামে করে দেব। আমি এখন অন্য ব্যবসা করব। যাতে সমাজে আমার একটা আলাদা ইজ্জত হয়।’
নিরাপদ বন্ধুরা ওর বাবাকে নিয়ে গর্ব করে। বাবা এখন কয়লা,বালি নিয়ে কারবার করছে। সেসব সাধারণ দোকান নয়। বাবার একটা ছোটো ব্রিফকেস আছে। তাতেই বিশাল কারবারের অফিস ঠেসে ঢোকানো।
আজকাল বাবার ছবি খবরের কাগজে বেরুচ্ছে। বাবাকে ব্যবসা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাঝে মাঝেই ডেকে পাঠানো হচ্ছে। বাবা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। ছ’সাত ঘন্টাবাদে বাইরে এলে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে নানা প্রশ্ন করছে। বাবা হাসিমুখে সব জবাব দিচ্ছে। বলছে, ‘আমি সবরকম সহযোগিতা করছি।’
‘আপনাকে যে বেশ কিছুদিন পাওয়া যায়নি এ বিষয়ে কিছু বলবেন?’
সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে একটুও না রেগে একটা মুচকি হাসি দিয়ে গুরুপদ বলেছেন, ‘আমি ব্যস্ত মানুষ আমাকে কি ডাকলেই পাওয়া যায়?’
ঘিরে থাকা সাংবাদিকরা অনেকেই আরও কিছু বলতে চাইছিল। বাবা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ওদের সরিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে।
বাবা কায়দা করে যখন যেমন, তখন তেমন হাসতে পারে।
সেই বাবা যখন নিরাপদর কাছে হিসেব নিতে বসল তখন কেমন গম্ভীর কন্ঠস্বর। রাগে থমথমে মুখ। দোকানে যত গয়না ছিল তার অনেকগুলি নেই। তার মানে নিশ্চয়ই বিক্রি হয়েছে। তাই যদি হবে তবে টাকা কই। টাকা যদি না থাকে তবে তা কিভাবে খরচ হল তার হিসেব কোথায়? এইরকম নানা প্রশ্ন।
নিরাপদ কোনো জবাব দিতে পারেনি। সেও অবাক হয়ে ভেবেছে কিছু তো বিক্রি হয়েছে, কিন্তু যে গয়না পাওয়া যাচ্ছে না সেগুলির বিক্রির টাকা কোথায় গেল। আর যদি টাকা না থেকে তাহলে গয়না কোথায়?
কর্মচারিদের ডেকে বাবা জিজ্ঞাসা করল। সে সব কঠিন প্রশ্নের সঠিক জবাব পেয়ে বাবা সন্তুষ্ট হল। বলল, ‘তোমরা যাও। ঠিক মতো কাজ কর।’
কর্মচারিরা নিশ্চিন্ত হলেও নিরাপদ বাবার ধমক খেল। বাবা বলল, ‘আরও ছ’মাস দেখব। এর মধ্যে যদি হিসেব না দিতে পার তবে এই দোকান আমি বিক্রি করে দেব। তুমি তোমার পথ বেছে নিও।’
বাবার কথায় নিরাপদ চিন্তায় পড়ল। প্রথম প্রথম তার দোকানে বসতে ভালো লাগত না। বন্ধুরা কত আড্ডা দেয়। কত রোমাঞ্চকর গল্প শোনায়। সেইসব অভিযানে সে যোগ দিতে পারে না। খুবই কষ্ট হত।
সব কষ্ট দূর হয়ে গেল যেদিন থেকে জুমেলা দোকানে এল। ও ওর নামের মতোই সুন্দরী। মন কত ভালো। গয়না দেখে আর গল্প করে নিরাপদর সঙ্গে। সময়টা যেন তখন মধুর হয়ে যায়।
বাবার ধমক খেয়ে মন ভালো করবার জন্য জুমেলার কথা ভাবতে লাগল নিরাপদ। আজ এলে ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে। জুমেলাকে বিয়ে করলে বাবার বকুনি মনে থাকবে না। মন ভালো হয়ে যাবে। তখন সে বাবার চাইতেও বড়ো ব্যবসার কথা ভাবতে পারবে।
দু’জনে মিলে বিদেশে যাবে। নানা দেশ ঘুরবে। আসার সময় বিদেশ থেকে লুকিয়ে সোনা নিয়ে আসবে। জুমেলা এই বিষয়ে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। আজই সব কথা বলে পাকা করে নিতে হবে।
কিছুদিন আগে নিরাপদ গরুর কথা ভেবেছিল। ওতেও শুনেছে কোটি কোটি টাকা আয়। তবে সোনার ইজ্জতই আলাদা। জুমেলার পাশে গরুটা ঠিক মানায় না। সোনা মানায়।
‘জুমেলা সোনা। জুমেলা সোনা।’ মনে মনে এই কথা বলতেই দেখল জুমেলা দোকানে আসছে। বুকটা যেন লাফিয়ে উঠল। জুমেলা হাসল।
অমনি চারিদিকে যেন এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল। নিরাপদ জুমেলার দিকে তাকিয়ে রইল।
জুমেলা বলল, ‘ভালো আছ?’
নিরাপদ বলল, ‘ ভালো। জুমেলা একটা কথা ছিল। ভাবছি তোমার বাবা মায়ের সঙ্গে একদিন দেখা করতে যাব।’
জুমেলা বলল, ‘কেন?’
ঘাবড়ে গেল নিরাপদ। বলল, ‘তোমার বাবা, মা, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের বলব আমার দোকান থেকে গয়না কিনতে।’
জুমেলা হেসে বলল, ‘ও তাই বল। আমি ভাবলাম কি না কি!’
নিরাপদ জুমেলাকে হাসতে দেখে নিশ্চিন্ত হল। যা বলতে চায় মনে হয় একটু রয়ে সয়ে বলা ভালো। এখনই নয়। তবে কিছু তো বলতে হবে। বলল, ‘আচ্ছা জুমেলা তুমি তো দোকানে এলেই গাদা গাদা গয়না দেখ। কোনোদিন তো কিনলে না। আমার খুব ইচ্ছে আমার দোকানের গয়না তোমার কাছে থাকুক।’
‘আছে তো। তোমার দোকানের অনেক গয়না আমার বাড়িতে আছে। আমি তো নিয়েছি।’
‘কখন নিয়েছ? আমি তো দেখিনি!’
‘দেখবে কি করে? তখন তো তুমি আমায় দেখতে।’