কিছু কেনার দরকারে লেক মলে গিয়েছিলাম। যখন চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি তখন আমার কিছুটা আগে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটি মেয়ের হাত থেকে একটা কাগজ সিঁড়িতে পড়ল। আমার মনে হল হয়ত কোনো জরুরি কাগজ। পড়ে গেছে। মেয়েটি টের পায়নি।
বললাম, ‘এই যে শুনছেন।’
যার হাত থেকে কাগজটি পড়েছিল সেই মেয়েটি আরও অনেক উপরের দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন মনে একটা উড়ন্তচাকি থেকে ভেসে আসা কোনো ডাক শুনবার চেষ্টা করছে।
আমার স্ত্রী ও মেয়ে আমাকে থামতে বলল। মেয়েরা এসব ভালো বুঝতে পারে। আমার স্ত্রী
বলল,’ওরা তোমার কথা শুনবে না। তুমি কিছু বোলো না।’
আমি কথা বললাম না। নিচে নেমে দেখলাম কাগজটি দরকারি নয়।
রাস্তায় অনেককে দেখেছি শেষ বিড়িটা নিয়ে প্যাকেট রাস্তায় ফেলতে। এভাবে ফেলেছে সিগারেট,গুটকার প্যাকেট,ঝালমুড়ি খাওয়ার পরে কাগজের ঠোঙা, জলের বোতল এরকম আরও অনেককিছু। সেগুলি গাড়ির চাকায় এদিক ওদিক ঘুরছে। রাস্তায় থেকেছে। উড়েছে। বন্ধ করছে ড্রেনের মুখ। নষ্ট করছে সৌন্দর্য। বাড়ছে দূষণ। বর্ষায় রাস্তায় জল আটকে গেছে।
এসব নিয়ে যেন কারও কোনো চিন্তা নেই। অনেক সময় দেখেছি যাঁরা চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেন তাঁরা যদি বোধের গভীরে না ঢুকে মঞ্চ এবং সভাগৃহের মধ্যেই তাঁদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখেন তখনই হয় সমস্যা। তাঁদের অনেকেই অন্যের সুবিধা অসুবিধার তোয়াক্কা না করে নিজের ভাষণের প্রশংসা শুনতে শুনতে গাড়িতে বসে সিগারেট ধরিয়ে, খালি প্যাকেট গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছেন।
এইভাবে আমরা হয়ত নিজের অজান্তে বা আমিও কখনো বিলি করছি নানা বিষয়ের দূষণ। আমার এক বন্ধু যে ফ্ল্যাটে থাকে সেখানকার এক মহিলা ঘরের ভিতরে দু’টো বাথরুম থাকলেও ছাদে স্নান করেন। সেখানে গিয়ে বাসন মাজেন আর উপর থেকে যাবতীয় নোংরা ফেলেন যত্রতত্র। যা হয় হোক কুছ পরোয়া নেই। অন্যের অসুবিধা নিয়ে ভাবতে বয়ে গেছে এমন ভাব। এমন লোকেদের কিছু বলতে গেলে তারা অন্যের উপর রেগে থাকবে।
বিড়ি বা সিগারেটের আগুন না নিভিয়েই জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলার অভ্যাস অনেকের আছে। এই কাজগুলিকে মহান কাজ বলে মনে করে তারা। এতে পরিবেশ যে ঠিক থাকে না! ছোটো একটা আগুনের ফুলকি থেকে কত দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এই আচরণ যে ঠিক নয় অনেক মানুষ পছন্দ করে না এটা বোঝার ক্ষমতা যেমন নেই, তেমন বোঝালেও বুঝতে চায় না।
যারা পরিবেশ বন্ধু তারা সামান্য টাকার বিনিময়ে সব পরিষ্কার করে। অন্যের আবর্জনা,ময়লা পরিষ্কার করার সময় তারা মনে মনে কি ভাবে কে জানে।
বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি আনার সময় সেটা লুকিয়ে আনতে হয় না। মদের বোতল কিনে সেটা হাতে ঝুলিয়ে কেউ আনছে এমনটা আমার চোখে পরেনি।
আমার পরিচিত একজন বলছিল তার ফ্ল্যাটের পাশে আবর্জনা জমে থাকে। জানালা বা ব্যালকনি দিয়ে উপরে থাকা লোকজন কিছু না কিছু ফেলেই যাচ্ছে। জমে থাকছে খালি মদের বোতলও। এসব শুধু যে ওই বন্ধুটির ফ্ল্যাটেই হয় তা নয়, হচ্ছে অনেক জায়গায়। এসব যারা করে তারা নিজেরা সচেতন না হলে কিছু করবারও নেই।
পয়সা দিয়ে ময়লা পরিস্কার করার লোক রাখা হয়েছে তাই বলে নিজেদের কিছু আড়াল থাকবে না। ভালো অভ্যাস তৈরি হবে না?
যারা প্রতিদিন পয়সার বিনিময়ে আমাদের বর্জ্য পরিস্কার করে তারা নিজেদের নিশ্চয়ই অপরিষ্কার রাখে না। একসময় খুব ঘুরতাম। গ্রামে গিয়ে দেখেছি মাটির বাড়ি হলেও তা কত সুন্দর করে সাজানো। মাটির দেওয়ালে ছবি আঁকা। ছবি যেমনই হোক আসলে সাজিয়ে রাখার ইচ্ছেটাই বড়ো কথা। দেওয়ালে ওই শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হতে হয়। এই সাজিয়ে রাখাতে তাদের মনের ভাবনাটাও ধরা পড়ে।
আমরা ঘরের ভিতরটা পয়সা খরচ করে নানাভাবে সাজাই। তাই নিয়ে কত খরচ হল এই গল্প কথা বলে তৃপ্তি পাই। যে আবর্জনা আমরা বাইরে ফেলি তা কখনও যে আমাদের পায়ে করে ঘরের ভিতরে ঢোকে না তা নিশ্চিন্ত হয়ে বলা যাবে না।
আমরা অনেকেই নিজেরা যে কাজ করে অর্থ উপার্জন করি বেশিরভাগ সময় সেই কাজে সন্তুষ্ট হই না। মনে হয় আরও ভালো কিছু হতে পারত। এই নিয়ে আক্ষেপ করতে শুনেছি অনেককেই।
যারা পরিবেশ বন্ধু তারা কি নিজেদের কাজে খুশি থাকে। মনে হয় না। অনেক সময় আবর্জনার রকম ও বহর দেখে গালাগালও করতে শুনেছি। সামনে গেলেই চুপ করে গেছে।
দেখলাম একটা লম্বা ঝাঁটা দিয়ে মেয়েটির ফেলে দেওয়া কাগজের টুকরোটি পরিস্কার করবার সময় বিড়বিড় করে কিছু বলছিল লোকটি। মেয়েদু’টি তা শুনতে পেল না । আমিও না।