সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ঊনচল্লিশ

টুকরো হাসি – ঊনচল্লিশ

স্বাধীনতার মূল্য

সদানন্দ উকিল বললেন,‘আসুন আপনাদের জন্যই আজ চেম্বারটা খুললাম। তা না হলে স্বাধীনতার ৭৫তম দিবসে খোলা উচিত ছিল না। এই দিনটির জন্য অজস্র শহিদকে বহু মূল্য দিতে হয়েছিল।’একটু থেমে বললেন, ‘বলুন আজই কি এমন জরুরি দরকার পড়ল আপনাদের?’
‘দরকারটা আমার। আমি আর ভোলানাথের সঙ্গে থাকতে চাই না।’
সদানন্দ উকিল কিছুক্ষণ ভাবলেন। বললেন, ‘যা বলছেন তা ভেবে বলছেন তো?’
‘হ্যাঁ। ভেবেই বলছি।’
‘আর একবার ফাইনালি ভাবুন। ঝিমঝিমদেবী, আপনারা যা করতে যাচ্ছেন তা ঠিক করছেন তো?
ঝিমঝিম ঝনঝন করে বলে উঠল, বারবার আপনি একই কথা বলছেন কেন বলুন তো? ভোলানাথ কিছু ভাবছে না। যা ভাবার ভেবেছি আমিই। ওকে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে এসেছি। কাজেই আপনারা বলবেন না। ওর কিছু ভাবার মুরোদ আছে নাকি?’
সদানন্দ উকিল আমতা আমতা করে বললেন,‘না মানে আমি বলছি এইজন্য যে, ভাঙ্গতে চাইলে তো তা অনায়াসে ভাঙ্গা যায়, কিন্তু জুড়তে অনেক সময় লাগে। তাই বারবার ভেবে দেখতে বলছি। এটা বলা আমার দায়িত্ব।’
‘আর ভাবা ভাবির কিছু নেই। আমি যা বলছি আপনি তাই করুন।’
সদানন্দ উকিল ভোলানাথ কে বললেন, ‘আপনারও কি একই মত?’
ভোলানাথ বলল, ‘আমার কোনো মতামত নেই। থাকলেও তা খাটবে না।’
‘কেন? আপনার মত নেই কেন?’
‘আমার মত আমি কোনদিন ঝিমঝিম কে বোঝাতে পারিনি। ও কিছুতেই বুঝতে চায় না।’
কেন বুঝতে চায় না?
‘আপনি কি বোঝাতে পারেন না?’
‘বুঝেয়েছিলাম। অন্য কোথাও যাওয়ার বদলে আমার বাবা মায়ের সঙ্গে থাকা ভালো। বাবা মা হচ্ছে মাথার ছাতার মতো।’
‘ঝিমঝিমদেবী। আপনি ভোলানাথবাবুর কথা শুনে কি বললেন?’
ঝিমঝিম বলল, ‘ওর সঙ্গে আমার মত মেলে না। ও পুরাতনপন্থী। তাই ও ওর বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতে চায়। আমি তা চাই না। আমি নতুন যুগের দূত।’
‘অদ্ভুত।’ ভোলানাথ বলল।
‘দেখলেন আপনার সামনেই কেমন আমাকে অদ্ভুত বলল।’
‘ওটা আসলে আমিই বলতে যাচ্ছিলাম। আপনি বলে ফেললেন কেন ভোলানাথবাবু?’
ভোলানাথ বলল, ‘ঠিক আছে আমি আর কিছু বলব না। যা বলার আপনিই বলবেন।’
ঝিমঝিম বলল, ‘আপনিই বা আমাকে বলবেন কেন? এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। এটা যে অদ্ভুত তা বলার অধিকার কি আপনার আছে?’
সদানন্দ উকিল বললেন, ‘আমি আপনার কথা ভেবে বলিনি।’
‘তাহলে? কার কথা ভেবে বলেছেন?’
সদানন্দ উকিল বললেন, ‘আপনার কথা শুনে আমার বউয়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।
তিনিও এই কথা বলেছিলেন। বিয়ের পরপরই।’
‘তবেই দেখুন যারা মহৎ হয়, তারাই এইসব কথা একইরকম করে ভাবে।’
সদানন্দ উকিল বললেন, ‘আপনারা যখন আমার কাছে বিয়ে করবার জন্য এসেছিলেন তখন বলেছিলেন, একজন ভালো বিবাহবন্ধনী অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিতে যাতে আপনাদের বিবাহ চিরকালের জন্য অটুট থাকে। কি বলেননি?’
‘বলেছিলাম তো।’ ঝিমঝিম বলল।
‘তবে এখন সমস্যাটা কি?’
‘আমার সঙ্গে ভোলানাথের মানসিকতার অনেক ফারাক।’
‘কি রকম?’
ঝিমঝিম বলল, ‘দেখুন আমি খুব সুন্দর সুন্দর দেখতে বড়োলোকের ছেলেদের ভালোবাসি।’
‘ভোলানাথবাবু তাদের ভালোবাসেন না?’
‘তবে তো আমার কোনো দুঃখ থাকত না। জানেন ও ভালোবাসে সুন্দরী মেয়েদের। বলুন তো এটা আমি কি করে সহ্য করতে পারি? এরকম মতের ফারাক নিয়ে একসঙ্গে থাকা যায়?’
সদানন্দ উকিল বললেন, ‘বটেই তো, বটেই তো। তাহলে আপনি এখন কি চান?’
‘আমি ডিভোর্স চাই।’ ঝিমঝিম বলল। ‘বিয়েটা আপনিই যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন, ডিভোর্সের ব্যবস্থা আপনিই করে দিন।’
‘দশলাখ টাকা লাগবে।’
‘দশলাখ লাগবে তো, ভোলানাথ দেবে। বিয়ের সময় ওই তো একলাখ দিয়েছিল।’
‘ভোলানাথবাবু তো ডিভোর্স চাননি। টাকা আমি আপনার কাছ থেকেই আদায় করব।’
‘তাই বলে, দশলাখ টাকা?’
‘ডিভোর্স পেয়ে আপনি কি করবেন?’
‘স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াব। আজ ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের দিন আমিও স্বাধীন হব। বড়োলোকের ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খাব। লং ড্রাইভে যাব। যা ইচ্ছে তাই করব।’
‘আপনি কি করবেন ভোলানাথবাবু?’ সদানন্দ উকিল বললেন।
‘আমার বাবা মার কাছে চলে যাব। ভাবব স্কুল জীবনের স্বাদ আবার ফিরে পেলাম। স্বাধীনভাবে বাঁচার নতুন করে সুযোগ পাব। আমাকে আর ঝিমঝিমের কথা শুনে আজীবন ঝিমিয়ে থাকতে হবে না।’
‘তার মানে? তুমিও আমার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন হচ্ছ?’
‘ওই মানে বাধ্য হয়ে।’ ভোলানাথ বলল।
ঝিমঝিম বলল, ‘উকিলবাবু আমি দশলাখ টাকা দিতে পারব না। বিয়েতে মাত্র একলাখ নিয়েছিলেন।ডিভোর্সে দশলাখ?’
‘বিয়েটা ছিল মধুর বন্ধন।তবু বন্ধন তো। সেই বন্ধন ছিঁড়ে এখন স্বাধীন হবেন এটা কি কম কথা?’
‘তাই বলে দশলাখ টাকা?’
‘টাকার কথা ভেবে মন ছোটো করবেন না। ওটা হল স্বাধীনতার মূল্য।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।