করোনা কেড়েছে অনেক কিছু।আমাদের সময়।মনের জোর।হারিয়েছি আত্মীয় পরিচিত মানুষদের।আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে অনেক।তবু আমপানের ঝড়ে ভেঙে যাওয়া ডাল থেকে সবুজ পাতা বেরিয়ে এসে সূর্যের আলো খুঁজে নিতে চাইছে।এও তো দেখেছি।এতোলবেতোল মাথার ভিতরটা।গুমোট অসহনীয় একটা সামাজিক অবক্ষয়ের সময়ে রোজই তাকিয়ে থাকি নতুন সময়ের আসার পথের দিকে।তাকিয়ে থাকা মানে নিজের মনকে ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা করা।জানি তো সে যখন শিয়রে এসে হাজির হবে আমার কোনো অনুরোধই শুনবে না। তবু।
এক চিলতে জায়গায়,যেখানে বসবাস সেখানে জমে আছে অনেক পত্র পত্রিকা।বই।সেদিকে তাকিয়ে আমার নিজের জন্য মায়া হয়।সেগুলিকে ফেলতেও পারি না।আবার মাঝে মাঝে মনে হয় কেন এই জঞ্জাল জমা করে রেখেছি।আমার আপনজনেরা যখন বিরক্ত হয় তখন মন খারাপ হয়ে যায়।ভাবি সব বিদায় করে দেব।প্রিয়জনেদেরও হয়ত তখন মায়া হয় বলে,‘একটু গুছিয়ে রাখলে অসুবিধা হবে না।’
একদিন সেই চেষ্টা করতে গিয়ে হাতে এল ‘গদ্যকবিতা’পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা।পত্রিকার সম্পাদক বন্ধু কবি সুভাষ গঙ্গোপাধ্যায়।১৯৯৯ এর বইমেলার কয়েকদিন আগে বলল, ‘এবার বইমেলায় গদ্যকবিতার ফোল্ডার বের করব।সঙ্গে থাকবি আর লেখা দিবি।’একই স্কুলে এক ক্লাসে পড়েছি আমরা।বললাম,’আছি।’
এ ফোর সাইজের একটি কাগজকে তিন ভাঁজ করে এপিঠ ওপিঠ ৬পৃষ্ঠা হল।তাতে প্রথম সংখ্যাতে সুভাষ,আমি আর নির্মল বসাক লিখলাম গদ্য, দুটি করে কবিতা লিখলেন গৌ্রশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও আবদুস শুকুর খান।গদ্য কবিতার ফোল্ডার ১থেকে ৫অবধি প্রকাশ করা হয়েছিল ওই বছরের বইমেলায়।বিলি করেছিলাম।
আমি খুঁজে পেলাম শধু ১,৩,৫ এই তিনটি সংখ্যা।সংখ্যাগুলিতে আরও যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা গল্পকার আশিস মুখোপাধ্যায়,কবি অনন্ত দাশ,গল্পকার সুব্রত নিয়োগী লিখেছিলেন কবিতা।কবি মনোজ নন্দী,ধূর্জটি চন্দ,সুব্রত রুদ্র,গল্পকার শংকর দাশগুপ্ত,ইনি পরে মেগা সিরিয়াল লিখে নাম করেছিলেন।এছাড়া এমন আরও অনেকের লেখা ছিল,২ আর ৪সংখ্যা দুটি পাওয়া গেল না তাই আন্দাজে বলতে পারছি না।
নির্মল বসাক,ধূর্জটি চন্দ ও সুব্রত নিয়োগীকে এমন করোনাকাল দেখতে হয়নি।তাঁরা অনেক আগেই চলে গেছেন।শংকর দাশগুপ্ত চলে গেলেন করোনার মধ্যেই।
একটা সময় ছিল যখন সবার সঙ্গেই আমার দেখা হত।আমার একটা দোষ বেশিক্ষণ কারও সঙ্গে আপনি করে কথা বলতে পারি না।মানুষটিকে ভালো লাগলে তুমি বলে ফেলি।তাতে কখনও আমাকে অসুবিধায় পড়তে হয়নি।অনেকেই ক্ষমাসুন্দর মনোভাব নিয়ে আমাকে সহ্য করেছেন।
গদ্য কবিতা-তে আমি লিখেছিলাম,‘গল্প নেইঃএক/দুই ও তিন।তারপরে বিভিন্ন কাগজে প্রায় তিরিশ অবধি লিখেছি।ইচ্ছে ছিল ১থেকে১০০অবধি লিখব।তা আর হয়ে ওঠেনি।কলকাতায় বসবাস করেন এমন অনেক হিন্দি কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় ছিল।পঞ্চাশের কবি নওয়লজি একটি হিন্দি পত্রিকায় গল্প নেই হিন্দিতে অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করেছিলেন।পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমারও লেখার ইচ্ছেটি নষ্ট হয়ে গেল।কবি নওয়ল-এর স্নেহধন্য অনেকের মধ্যে আমিও একজন।আবার লিখছি শুনলে তিনি খুশি হতেন।তা হওয়ার নয়।করোনাকালে তিনিও চলে গেছেন অন্যলোকে।
একটা জীবনে কত যে ঝড়,চোরা স্রোত তা বলার নয়।সব কথা বলা যায় না।যাবে না।কত কথাই যে গোপন থেকে যাবে যা আমি ছাড়া কেউ জানতেও পারবে না।অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি তাঁরাও আমার সঙ্গে একমত।বলেছেন,অনেকেই যা বলেছেন তার চেয়ে বেশি কথা না বলা থেকে গেছে।লুকিয়ে রেখেছেন।তার হদিশ কেউ পায়নি।পাবেও না।
যদি ‘গদ্য কবিতা’র ৩টি সংখ্যা খুঁজে না পেতাম তাহলে হয়ত এই লেখার কথা মনেও হত না।পেয়ে ভাবলাম যদি আবার নতুন করে শুরু করা যায় তবে কেমন হয়।যদি আগের লেখা কিছু খুঁজে পাই সেগুলিও না হয়
থাকবে।তাহলে এই যে মাথার ভিতরে করোনার তীব্র ঝটকায় কেমন ওলোট পালোট হয়ে যাওয়া সবকিছু, তার খানিকটা হয়ত গুছিয়ে নেওয়া যাবে।মনের ভিতরে আশা,যদি ইচ্ছে জন্মায় দু’হাত পেতে শুদ্ধ বাতাস নিতে।
যে কাগজটিতে কিছুদিন ধরে নিয়মিত লিখছি সেই Tech Touch Talk-এ বিষয়টি জানাতেই ঋষি ভট্টাচার্য এককথায় রাজি।বয়সে অনেক ছোটো হয়েও সে যে আমার জন্য কত বড়ো কাজ করল,তা ও নিজেও জানে না।এটা তো চরম বাস্তব।একেবারেই গল্প নেই।