সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ৩৫

গল্প নেই – ৩৫

তখন স্কুলে পড়ি।একদিন ক্লাসে একটা নোটিশ এল ।নোটিশে বলা হয়েছে,স্কুল থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হবে। সেখানে যারা কবিতা,ছড়া,গল্প লিখতে চায় তারা যেন সময় মতো লেখা জমা দেয়।
ছড়া,গল্প,কবিতা আরও অন্যকিছু তো অন্যরা লেখেন।আমরা পড়ি।আমরা লিখব মানে! এইকথা ভাবতে গিয়ে আমি নানা চিন্তার মধ্যে ঢুকে গেলাম।এক সময় বললাম,‘আমি লিখব।’
কথাটা শুনতে পেল আমার পাশে বসে থাকা ক্লাসের এক বন্ধু।বলল,‘তুই কি লিখবি?’
সাত পাঁচ কিছু না ভেবেই বললাম,‘গল্প।’
‘তাহলে তুই দুটো গল্প লেখ।’
‘কেন? দু’টো লিখব কেন? নোটিশে তো বলেছে যে কোনো একটি বিভাগেই লেখা দেওয়া যাবে।’
বন্ধুটি বলল,‘একটা গল্প তোর নামে লিখবি আর অন্যটা আমার।’
লেখা জমা দেবার শেষদিনের দু’দিন আগে অবধি আমাকে রোজ লেখার জন্য তাগাদা দিয়ে গেল বন্ধুটি।ওর তাড়ায় বাধ্য হয়ে দুটো গল্প লিখলাম।একটি আমার নামে জমা দিলাম।অন্যটি বন্ধুটিকে দিলাম। 
একদিন পত্রিকা প্রকাশ হল।পত্রিকা হাতে পেয়ে খুঁজে দেখলাম।আমার নাম কোথাও পেলাম না।বন্ধুটিকে যে গল্প লিখে দিয়েছিলাম সেটি প্রকাশিত হয়েছে।দেখে খুব ভালো লাগল।তবে গল্পের নামের নিচে বন্ধুটির নাম।
ওকে দেখিয়ে বললাম,‘দেখ আমার এই গল্পটা বেরিয়েছে।’
বন্ধুটি রেগে গেল। বলল, ‘চুপ কর।এ কথা কাউকে বলিস না।কেউ বিশ্বাস করবে না।শুনলে সবাই হাসবে।’
ক্লাসের সবাই বন্ধুটির গল্প বেরিয়েছে দেখে হইহই করে আনন্দ করছে। আমি সবার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে আনন্দ করতে পারছি না।ভিতরে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে।আমি তা প্রকাশ করতে পারছি না। আবার আনন্দও হচ্ছে।
কেন দুটো গল্পই প্রকাশিত হল না!আমার দুটি লেখার কোনোট খারাপ হোক আমি তা চাইনি। লিখবার সময় আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি যাতে দু’টিই ভালো হয়।
আমার অন্য গল্পটি যেটি প্রকাশিত হয়নি সেই জমা দেওয়া লেখাটি আর ফেরত পাইনি। কি যে লিখেছিলাম তা এখন আর মনেও নেই।
আমাদের স্কুলের পত্রিকার প্রচ্ছদ যে এঁকেছিল সে আমার এক ক্লাস উপরে পড়ত।আমাকে খুব ভালোবাসত।স্কুলের শেষ পরীক্ষার পর আমি ইছাপুরে চলে যাই।
বহুবছর বাদে যখন কলেজস্ট্রিট কফিহাউসে আমার সেই দাদার সঙ্গে দেখা তখন সে একজন কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী।
যখন স্কুলে পড়তাম তখন ওই দাদার বাড়িতে যেতাম।দেখতাম তুলি,কাগজ,রং নিয়ে বসে আছে।চারিদিকে আঁকার সরঞ্জাম।ওইসব আমার দেখতে ভালো লাগত।ওই টানে মাঝে মাঝেই যেতাম।দাদা বুঝতে পারত আমার ওই দাদার আঁকা,লেখা এইসব ভালো লাগে।
একদিন আমাকে বলল,‘তোমাদের ক্লাসের একজন স্কুল ম্যাগাজিনে গল্প লিখেছে।তুমি একটা লিখলে না কেন? দেখ না চেষ্টা করে।এর পরের বছর পত্রিকা বেরোবার আগে একটা গল্প দিও।’
আমি যে গল্প দিয়েছিলাম ও আমার ক্লাসের বন্ধুটির যে গল্পটি বেরিয়েছে এই দুটোই যে আমার লেখা এসব কথা বললাম না।
আমাদের একজন স্যার যিনি বাংলা পড়াতেন তিনি ছিলেন স্কুলের পত্রিকাটির সম্পাদক । প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও সেই স্যারের বাড়িতে পত্রিকার বিষয়ে আলোচনা করতে যেতে হত দাদাকে।
আমাকে বলল,‘তোমাদের ক্লাসের যে ছেলেটির গল্প বেরিয়েছে সে তো মাঝেমাঝেই স্যারের বাড়িতে যেত।একটা গল্প জমা দিয়েছে সে কথাও রোজ বলত স্যারকে।’
আমিও যে একটি গল্প জমা দিয়েছি সে কথা স্যারকে বন্ধুটি নিশ্চয়ই বলেনি।স্যারকে শুধু নিজের কথাই বলেছে।
সেই স্কুলজীবনে আমার সঙ্গে যা শুরু হয়েছিল,সেই থেকে দেখেছি জীবনের অনেকক্ষেত্রেই আমার সংরক্ষিত যা কিছু সব লুট হয়ে গেছে।আমার যে একেবারে কিছু হওয়ার ছিল না তা নয়। ভেবেছিলাম তা আসবে স্বাভাবিক নিয়মেই।এখন যখন আর নতুন করে কিছু হবার নেই তখন বুঝি সব স্বাভাবিক নিয়মে হয় না।শিল্পে,সাহিত্যে,রাজনীতিতে ও জীবনের সবক্ষেত্রেই মনে মনে নিজের দু’কান কেটে ফেলতে হয়।হাসি চওড়া করে কান অবধি নিয়ে নিজেকে হাজির করে জাহির করতে হয় সর্বত্র।রপ্ত করতে হয় নানা কিসিমের মোসাহেবি।সঙ্গে রাখতে হয় একটি ঝোলা।
দিনের শেষে মেলাতে হয় কতটুকু সংগ্রহ হল।লাভ ক্ষতির হিসেব করতে হয়।পারলে ভালো,যে এসব না পারে তার কিছুই আর হওয়া হয় না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই একই নিয়ম।ক’জন পারে উদাসীন হয়ে থাকতে? সে বড়ো সহজ কথা নয়।কেন,না পাওয়ার দুঃখ ভুলে নকল আনন্দ বয়ে বেড়াতে হবে? সবাই কি মহাপুরুষ হতে পারে?
যার যেটুকু পাওয়ার যোগ্যতা আছে তাতে যতটুকু পাওয়ার সেটুকু সে এমনিতেই পাবে না কেন?
পেতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই তাকে নির্লজ্জ পোশাকে স্তাবক সেজে তবেই যোগ্য হতে হবে?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।