সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্তী (ইতিহাস কথা পর্ব ২)

শ্রীরামপুরের কথা

উড়িষ্যায় পাঠান সর্দার কোতলু খাঁকে শায়েস্তা করতে আগ্রা থেকে বাদশা আকবর বাংলায় পাঠালেন রাজা মানসিংহকে। সঙ্গে বিশাল সেনাবাহিনী। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে মানসিংহ শিবির করলেন শ্রীপুর ও জাহানাবাদের মাঝামাঝি স্থানে। বর্ধিষ্ণু সে গ্রাম। পুরো গ্রামে বহুঘর ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের বাস। ব্রাহ্মণ বলতে চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য্য, তর্কালঙ্কার, চৌধুরী এবং কায়স্থদের মধ্যে বসু, সরকার, পাল ও দত্ত বংশ উল্লেখযোগ্য। সারা বাংলায় শ্রীপুরের ব্রাহ্মণ সমাজের তখন প্রচুর হাঁকডাক। চারপাশে টোল, চতুষ্পাঠী। শ্রীপুর মোহনপুর শাসনের ভার তখন বাংলায় বিখ্যাত পাটলির কায়স্থ দত্ত জমিদারদের হাতে। শোনা যায় আকবর বাদশাও এই ক্ষমতাশালী জমিদারদের কিছু জমি ও সনদপত্র দিয়ে সম্মান জানিয়েছিলেন একসময়। এমনই ছিল তখন সারা বঙ্গে বারো ভুঁইয়ার প্রতাপ। সেনা, অর্থ ও ক্ষমতাবলে তাঁরা এককথায় স্বাধীন। পাটলির জমিদারদের আদি পুরুষ দেবদত্তকে নিয়ে শোনা যায় এক কাহিনী। তখন প্রাচীন বঙ্গের রাজা আদিশূর। কান্যকুব্জ পরিত্যাগ করে কায়স্থ দেবদত্ত এসেছিলেন বাংলায় বসবাসের জন্য। প্রথমে বর্তমান মুর্শিদাবাদে বাস করলেও পরে পাটলিতে বসবাস শুরু করেন তিনি। মুঘল বাদশাহরা বাংলার যেসব জমিদারগণকে তাঁদের ক্ষমতা ও প্রতাপের জন্য ‘মজুমদার’ উপাধিতে ভূষিত করেন, পাটলির দত্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। দিল্লীর মসনদে তখন মুঘল বাদশা ঔরঙ্গজেব। পাটলির জমিদার তখন প্রতাপশালী রামেশ্বর রায় (দত্ত)। তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে বাদশা তাঁকে দান করলেন ‘রাজা মহাশয়’ উপাধি। বাদশাহের ফরমান অনুযায়ী বংশানুক্রমিকভাবে প্রতি প্রজন্মে রাজবংশের প্রথম সন্তান লাভ করে এসেছেন বাদশাপ্রদত্ত এই উপাধিটি। এরপর রাজা মহাশয় মনোহর চন্দ্র রায় পাটলি থেকে রাজপাট সমেত চলে আসেন শেওড়াফুলীতে। তাঁর সময়েই অসংখ্য টোল চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা, পুকুর খনন, মন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সেজে উঠতে শুরু করে বর্তমান শ্রীরামপুর। এমনকি রাজা মনোহর চন্দ্রই মাহেশের বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরটি তৈরি করে দেন। এছাড়াও শেওড়াফুলীর সর্বমঙ্গলা মন্দির, নিস্তারিণী কালীবাড়ি, আকনা গ্রামের রামসীতা মন্দির এই বংশের রাজাদের হাতেই নির্মিত। মতান্তরে শোনা যায় আকনার রামসীতা থেকেই শ্রীরামপুর নামের সূত্রপাত।
পুণ্যাত্মা ব্রাহ্মণ ধ্রুবানন্ধ ব্রহ্মচারী মাহেশের জগন্নাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবার পরে মন্দির ও বিগ্রহ সেবার ভার তুলে দেন চৈতন্য পার্ষদ কমলাকর পিপলাইয়ের হাতে। আজও জগন্নাথ মন্দিরের প্রাঙ্গনেই তাঁর পূণ্য সমাধিমন্দির যাত্রীদের প্রধান একটি আকর্ষণ। শেওড়াফুলীর রাজা মনোহরচন্দ্র প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ মন্দিরের উন্নতিকল্পে দান করেন। কমলাকর প্রতি বছর জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার আগে রাজা মনোহর চন্দ্র রায়ের থেকে অনুমতি গ্রহণ করতেন। রাজার মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায় আনুষ্ঠানিক ভাবে এই অনুমিত প্রদান করতেন সেবায়েত ব্রাহ্মণদের। তারপর একে একে রাজা আনন্দচন্দ্র, রাজা হরিশ্চন্দ্র, রাজা যোগেশচন্দ্র, রাজা পূর্ণচন্দ্ররাও পারিবারিক সূত্রে এই অধিকার লাভ করেন। প্রতি বছর জগন্নাথের স্নানযাত্রার আগে আজও ওই রাজবংশের প্রতিনিধির থেকে অনুমতিগ্রহণের নিয়ম পালন হয়ে আসছে। রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়ের সময়ে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা নিয়ে এক মহা বিপত্তির কথা লিখে গেছেন হুগলীর কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট টনবি সাহেব। তিলি বংশের জনৈক এক বণিক হঠাৎ মাথা হয়ে ওঠেন হিন্দু সমাজের। মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরের সেবায়েত ও ব্রাহ্মণদের নগদ অর্থে একরকম বশ করে সর্বেসর্বা হয়ে বসেন মন্দিরের। ইতিমধ্যে হাজির হয় জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। মন্দিরের সেবায়েতরাও তাঁর কাছে থেকে অনুমতি গ্রহণ করে স্নান করান জগন্নাথদেবকে। এদিকে শেওড়াফুলী থেকে মাহেশ আসার পথে এই খবর পৌঁছোয় রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়ের কানে। তখনি রাগে দ্রুতগামী ঘোড়ায় তিনি পৌঁছে যান মন্দিরে। বহু কালের প্রথা। রাজপরিবারের ঐতিহ্য। অথচ প্রথম রাজ অনুমতি ছাড়াই স্নান করানো হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা মূর্তি। যথারীতি মন্দিরের দেবায়েতদের অপরাধী ঠাওরে বন্দি করে প্রাসাদে নিয়ে যান রাজা। উচ্চস্থানীয় ব্রাহ্মণদের অনুরোধে সকলে পরে মুক্তি পেলেও এরপর থেকে আর কখনো নিয়মের অন্যথা দেখা যায় নি। ‘কলকাতা রিভিউ’ নামক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ লিখছে, এক ব্রাহ্মণ তৎকালীন নবাব সরকারের কোষে খাজনা দিতে অক্ষম হওয়ায় রাজা মনোহর চন্দ্র সেই খাজনা পরিশোধ করেন। ব্রাহ্মণ রক্ষা পায় অপমানের হাত থেকে। এরপরই রাজার উদারতার জন্য নবাব তাঁকে ‘শূদ্রমণি’ উপাধি দেন। এমনই ছিল মুঘল ও নবাব আমলে শেওড়াফুলীর বীর জমিদারদের শৌর্য। দিনেমার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাবিকরা নবাব আলীবর্দি খাঁয়ের থেকে সনদ নিয়ে শ্রীরামপুরে বাণিজ্যকুঠি তৈরি করবার জন্য হাজির হলে শেওড়াফুলীর তৎকালীন রাজা মনোহরচন্দ্র রায় বার্ষিক ১৬০১ টাকা করের পরিবর্তে তাঁদের তিনটি গ্রামে বাণিজ্য করবার পাট্টা দেন। এই তিনটি গ্রামই শ্রীপুর, মোহনপুর ও গোপীনাথপুর। যারই পরিবর্তিত রূপ আজকের ঝকঝকে শ্রীরামপুর নগরী। আগামী পর্বগুলোয় আমরা ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করব ব্রিটিশদের করাল গ্রাসে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাওয়া বাংলার মধ্যেই শ্রীরামপুরের মাটিতে দিনেমার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেইসব উজ্জ্বল দিনগুলোকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।