• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ১৯)

শ্রীরামপুরের কথা

মনোহর রায়ের শ্রীরামপুর, গোস্বামীদের শ্রীরামপুর, ড্যানিশ শ্রীরামপুর, মিশনারী শ্রীরামপুর অথবা ইংরেজদের শ্রীরামপুর। এই সবকটি শ্রীরামপুরের মধ্যেই আপাদমস্তক মিশে আছে আসলে বাঙালীর একাত্মবোধ। তাই দীর্ঘ সময় খ্রীষ্টান শাসিত ও মিশনারীদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও এই শহরে নিয়মিত পুজিত হয়ে এসেছেন বল্লভপুরের রাধাবল্লভ বিগ্রহ। আবার শ্যামবাজারের বসুদের দ্বারা সেবিত হয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে নিয়ম করে রথে চড়েছেন মাহেশের বিখ্যাত জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা বিগ্রহ। তাই শহরের হিন্দু ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। একসময় শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ কমলাকর পিপলাই ভক্তিভরে সেবা করতেন মাহেশের জগন্নাথদেবকে। আজও মাহেশের মন্দির চত্ত্বরে দেখা যায় তাঁর পবিত্র সমাধি মন্দির। কমলাকর হলেন সুন্দরবনের খালিঝুলির জমিদার সন্তান। চৈতন্যদেবের ভক্ত হিসাবে পরিচিত তিনি দ্বাদশ গোপালের পঞ্চম ও চৌষট্টি মহন্তের প্রথম। শোনা যায় শ্রীচৈতন্যের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েই তিনি বৃদ্ধ ধ্রুবানন্দের পরে মাহেশের মন্দির ও বিগ্রহ সেবার দায়িত্ব নেন। এরপর জগন্নাথ একান্ত ভাবে হয়ে ওঠে কমলাকরের জগন্নাথ। তাঁর বংশধরেরা আজও পরম্পরা পালন করে দেবমূর্তির সেবা করে আসছেন ভক্তিভরে।
গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারাণসী সমতুল। এই হিন্দু ভক্তিভাবে বিশ্বাসী বাঙালী যুগ যুগ ধরে ভিড় জমিয়েছে শ্রীরামপুরে। শহরের নামকরণের উৎস রামসীতা মন্দিরের কথা আগেই বলেছি। এবার বলব মাহেশের রথের কথা। যার সঙ্গে মিশে আছে ধ্রুবনন্দ ব্রহ্মচারীর লোককথা। ৬০০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা। পুরীর জগন্নাথকে নিজে হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন বলে মনস্থির করে গিয়েছিলেন বাঙালী সাধু ধ্রুবানন্দ। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন স্থানীয় পান্ডারা। তাঁরা ভোগদানের অধিকার কেন ছাড়বেন অচেনা সাধুর হাতে। এই নিয়ে বিবাদ। স্বভাবতই বিফলমনোরথে ফিরলেন ধ্রুবানন্দ। কিন্তু শুরু করলেন ঘোর অনশন। তিনদিন পরে ভগবান জগন্নাথের স্বপ্ন পেয়ে হুগলীর মাহেশ গ্রামে ফিরে এলেন তিনি। নদীতে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে তৈরি করলেন তিন দেবতার মূর্তি। তারপর থেকেই মাহেশে পুজিত হতে থাকলেন এই দারুমূর্তি। এতো গেল হিন্দু বিশ্বাস আর লোককথার কাহিনী। যে বিশ্বাসে ভর করে ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এই রথ উৎসবে ছুটে আসেন লাখো ভক্তের দল। কিন্তু এই মন্দির আর রথের উৎসসন্ধান না করলেই নয়। সময়ের সরণি বেয়ে পিছিয়ে গেলে প্রথমেই যে দুজন মানুষের কথা উঠে আসে, তাঁরা হলেন কলকাতার বড়বাজারের নয়নচাঁদ মল্লিক (অথবা নারায়ণ চন্দ্র মল্লিক) আর শ্যামবাজারের কৃষ্ণচন্দ্র বসু। যদিও দুজনের সময়কালে শতাধিক বছরেরও বেশি পার্থক্য। কিন্তু আজকের মাহেশে জগন্নাথ মন্দিরও যত্ন করে ধরে রেখেছে এই দুটি নামকে। ধ্রুবানন্দের হাতে প্রতিষ্ঠিত ও চৈতন্য পার্ষদ কমলাকরের হাতে সেবিত জগন্নাথ বিগ্রহকে শ্রীমন্দির বানিয়ে পাকাপাকি ভাবে স্থান দেন নয়নচাঁদ। সময়টা পলাশীর যুদ্ধের ঠিক দুবছর আগে। অর্থাৎ ১৭৫৫। শোনা যায় ১৩৯৭ সালে ধ্রুবানন্দের হাতে প্রতিষ্ঠিত মন্দির সংস্কার করে একেবারে নতুন রূপদান করেন নয়নচাঁদ। ৭০ ফুট উঁচু পুরীর মন্দিরের আদলে নির্মিত এই মন্দির তৈরি করতে ২০ হাজার টাকা খরচ করেন নয়নচাঁদ। প্রায় তিন বিঘা জমির উপর নির্মিত মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতার জন্য নিয়মিত সাড়ে বারো সের চালের অন্নভোগ দেয়া হয়। প্রথম থেকেই প্রতি বছর রথে চড়েন জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা। বর্তমান রথটি ১৮৮৫ সালে তৈরি করে বিখ্যাত মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানি। পৃষ্ঠপোষকতায় হুগলীর দেওয়ান ও শ্যামবাজার নিবাসী কৃষ্ণচন্দ্র বসু। এর আগে আরও কয়েকটি রথ অবশ্যই ছিল। কিন্তু কোনও না কোনও বাধায় নষ্ট হয় সেগুলো। যেমন কৃষ্ণচন্দ্রের রথের আগে যে রথে চড়তেন তিন দেবমূর্তি, সেটি বানিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতার বিশ্বম্ভর বসু। কিন্তু হঠাৎ সেটি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায় বলে শোনা যায়। কৃষ্ণচন্দ্রের রথে চড়েই আজও জগন্নাথ প্রতি বছর ঘুরে আসেন মাসীর বাড়ি থেকে। প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এই রথটি বানাতে বিশ লক্ষ টাকা খরচ হয়। বাংলার নবরত্ন মন্দির ঘরানায় নির্মিত এই রথে মোট ১২ টি লোহার চাকা। সামনে ঘোড়া। রথের ওজন ১২৫ টন। চারটি তলার একদম উপরে বসেন তিন দেবতা। নীচের তলায় চৈতন্যলীলা, মধ্যে কৃষ্ণলীলা এবং তার উপরে রামলীলা আঁকা রয়েছে।
শ্রীরামপুর মাহেশের রথ বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পদ। খ্রীষ্টান শাসিত শ্রীরামপুরেও কখনো ছেদ পড়েনি মাহেশের জগন্নাথ সেবায়। আজ রথের দিনে জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা রথে চড়ে ১ কিলোমিটার দূরে মাসীর বাড়ি মন্দিরে গেলেও আগে আসতেন বল্লভপুরের রাধাবল্লভ মন্দিরে। তারপর সাতদিন থেকে উল্টোরথের দিন আবার ফিরতেন মন্দিরে। কিন্তু বাদ সাধলো দুই মন্দিরের পূজারী ও সেবায়েতরা। দুই মন্দিরে প্রণামীর টাকা বিষয়ক দ্বন্দ্ব বাঁধলে বন্ধ হয়ে যায় এই প্রাচীন প্রথাটি। এরপর রাধাবল্লভ মন্দিরেও পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় জগন্নাথ মূর্তি। এবং এই সূত্র ধরেই পৌঁছে যেতে হয় রাধাবল্লভের আটচালা মন্দির দালানে। সেও এক জীবন্ত কিংবদন্তি। আর সেখানেও জড়িয়ে রয়েছেন কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিকের নাম। মাহেশের মন্দির বানিয়ে দেবার পর তিনি হাত দেন রাধাবল্লভ জিউ মন্দির সংস্কারে। অবশ্য রুদ্ররামের হাতে রাধাবল্লভ প্রতিষ্ঠা পাবার পরে যে প্রাচীন মন্দিরে দেবমূর্তি পূজিত হতেন সেটিই আজকের হেনরী মার্টিন প্যাগোডা। মন্দির পরিণত হয় গীর্জায় এবং তারপরে রাম তৈরির কারখানাতেও। কিন্তু কে এই রুদ্ররাম। আর কী সেই রাধাবল্লভের ইতিহাস। তোলা থাক পরের পর্বে।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।