।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় কৃপা বসু

বেশ কিছু বছর আগের ঘটনা, তখন আমি কুড়ি বা একুশ, আমাদের পাড়ায় একটা ছোট্ট সাজানো গোছানো পার্ক মতো ছিল। সেই পার্কের বেঞ্চিতে দুটো ছেলে মেয়ে এসে রোজ গল্প করতো বিকেলবেলায়, বাচ্চারা সামনে খেলতো, ঝালমুড়ি দাদু বেঞ্চির এক কোনায় বসতো, ঝালমুড়ি বানাতো….

বেশ কিছু মাস পর ছেলেমেয়ে দুটো আর আসেনা, বেঞ্চি ফাঁকা পড়ে থাকে, গাছ থেকে পাতা উড়ে এসে পড়ে, ধুলো জমা হয়। কিন্তু ছেলে মেয়েদুটো আর ফেরেনা….

খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে, আর ছেলেটা এখন পাক্কা নেশাড়ু, অথচ ওরা যখন দেখা করতো, কোনোদিনও ছেলেটাকে একটা সিগারেট ধরাতে দেখিনি।

আমার বড় অভিমান হয় ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য নয়, বরং ওই বেঞ্চিটার জন্য, মাঝেমধ্যে বেঞ্চিটার কথা ভাবি, সেই বাচ্চাগুলোর কথা ভাবি, ঝালমুড়ি দাদুর কথা ভাবি, এখনো ঝালমুড়ি বানাও দাদু?

কিছু মুখ মনে পড়ে, যারা জীবনে এসেছে, উপচে পড়ে গায়ে জল ঢালার মতো ভালোবাসা ঢেলেছে আর তারপর শুকনো কোনা ভাঙা বালতির মতো অকেজো বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে…

মানুষ গুলোকে ভুলে গেছি, কিন্তু সময়গুলো!! ওই বেঞ্চিটা, একটা গোটা বর্ষাবিকেল, রোদ মেলা শীতের দুপুর, লুকিয়ে দেখা করা, সিনেমা দেখতে যাওয়া! এই মুহূর্ত গুলো এই জায়গা গুলো কে ভোলাবে?? কে রগড়ে রগড়ে ডিলিট করে দেবে এই সময়গুলো জীবন থেকে….

পুজো আসলেই ফেরিওয়ালার কথা এখনো মনে পড়ে, যে লাল নীল চুড়ি টিপ ও কাজল নিয়ে আসতো। ফেরিওয়ালার মুখ ভুলে গেছি, কিন্তু উনি যে বাক্সে করে রকমারি দ্রব্যাদি আনতেন, সেই কাঁচের বাক্সের কথা ভুলিনি।

পুজো এলে কাজের দিদার কথা মনে পড়ে, আগের বছর মারা গেছেন, তার অনেক বছর আগেই কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। পুজোর আগেটায় মা আমার হাত দিয়ে দিদাকে ৫০০টা টাকা বোনাস দেওয়াতো, শুধু তাই নয় আলতা সিঁদুর ব্লাউজও দিতো মা ওঁকে…

দিদার মুখের চামড়া কতটা ঝুলে পড়েছিল ভুলে গেছি, কিন্তু ওইযে ৫০০টাকার গন্ধ আর টাকাটা নেওয়ার সময় দিদার চোখের চকচকে জল ভুলিনি….

পুজোর সময় রোজ বাড়িতে মাছ মাংস হতো, সকালে উঠে বাবা বাজার ঘাট করে পাড়ার পুজো মন্ডপে গিয়ে বসতো জেঠুর সাথে দুটো লাল চেয়ারে।

জেঠু মারা গেছেন আগের বছর, বাবা বহু বছর হলো পুজো মন্ডপে যায়না, মাছ মাংস আনে না, লোক দিয়ে আনিয়ে নেয়। বাবা প্রতিবার একটা করে নতুন জামা নিজের জন্য কেনে ঠিকই, কিন্তু পরে না…

ওই লাল চেয়ার দুটোতে অন্য কেউ বসে, আমার অভিমান বাড়ে একটু একটু করে, আমার অভিমান বাড়ে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।