গারো পাহাড়ের গদ্যে জিয়াউল হক

বীর মুক্তিযোদ্ধা সরকার আলী আসগর

আমি সরকার আলী আসগর, এফ.এফ.                                                                                                                                             গেজেট নম্বর-উল্লাপাড়া-১৫৩৫,  লাল মুক্তিবার্তা নম্বর-০৩১২০২০০০৮, এমআইএস নম্বর-০১৮৮০০০৩২৯৮,                    পিতা ঃ ফুলজার হোসেন, মাতা ঃ আছিয়া খাতুন,                                                                                      স্থায়ীর ঠিকানা ঃ গ্রাম ঃ কানসোনা, ডাকঘর-সলপ-৬৭৬৩, উপজেলা ঃ উল্লাপাড়া, জেলা ঃ সিরাজগঞ্জ।                                                              বর্তমান ঠিকানা ঃ  ফ্ল্যাট নম্বর-৬/এ,  ৩৯, নর্থ সার্কুলার রোড, থানা ঃ কলাবা্গান, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫।

১৯৭০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর আমি গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলাম।  আমরা যখন স্কুলের ৮ম শ্রেণিতে পড়াশুনা করতাম, তখন ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জা প্রতি সপ্তাহে স্কুলে এসে আমাদের রাজনৈতিক বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন।  তার ফলে আমরা ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করি। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না। ফলে সারা বাংলাদেশে প্রবল গণআন্দোলন শুরু হলো।  ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার আহবান জানাতোর পর পরই আমরা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারলাম যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। তখন থেকেই আমরা এলাকার যুবক ছেলেরা সংগঠিত হওয়া শুরু কররাম। ২৫ মার্চ রাতে পাকসেনারা সারা বাংলাদেশে আক্রমণ চালানোর সাথে সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে শুরু হলো প্রতিরোধ যুদ্ধ। তখন আমরা ভেবে দেখলাম সামরিক প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্র ছাড়া শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করা যাবে না। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য জুন মানের প্রথম দিকে আমরা ৯ জন বন্ধু কাজীপুর থানার শুকগাছা ঘাট থেকে নৌকাযোগে যমুনা নদী হয়ে ভারতের পথে যাত্রা করে আসাম রাজ্যের মানকার চর হয়ে রংপুর জেলার রৌমারী ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

রৌমারীতে ৫ দিন থাকার পর পাকসেনারা আমাদের ক্রাম্পের উপর আক্রমণ চালালে আমরা মানকার চরের পাশের  মারিংটিলা পাহাড়ের উপরে তাবু খাটিয়ে থাকা শুরু করলাম। সেখানে ২ দিন থাকার পর জুন মাসের ১৫ তারিখে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের তুরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ১ মাস প্রশিক্ষণ শেষে আগষ্ট মাসের ২০ তারিখে শামীম আহমেদকে কমান্ডার করে ১৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটা কোম্পানী গঠন করে আমাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রদান করা হয়। তারপর আমাদের কোম্পানীকে মেঘালয় রাজ্যের বর্ডার সংলগ্ন  মহেন্দ্রগঞ্জ অপারেশন ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়।  মেজর তাহের এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে ৩ দিন অবস্থানের পরের দিন খুব ভোর রাতে ফলিং করানোর পর জানানো হলো আজ আমাদের কামালপুর ফ্রন্টে সন্মুখ যুদ্ধে যেতে হবে।

 কামালপুরের যুদ্ধ ঃ একজন সামরিক কর্মকতার্ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের ফলিং করে চারিদিকে চক্কর দিয়ে  আমাদের সবার মনের অবস্থা পরখ করছেন। আমরা নির্ভয়চিত্তে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ কয়েক বার চক্কর দেওয়ার  পর তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজ তোমরা ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুসেনাদের কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করতে যাবে। আজকের অপারেশনের তুমিই কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করবে। তুমিই এমএমজি ব্যবহার করবে। অন্যরা এসএলআর ও রাইফেল ব্যবহার করবে। তোমাদের গাইড করার জন্য ইনটেলিজেন্সের একজন সেনা কর্মকর্তা থাকবে। তার হাতে থাকবে বাইনোকুলার।  এলাকাটি তার ভালোভাবে চেনা। তিনি তোমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন। তাই তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। অস্ত্রগার থেকে অস্ত্র নিয়ে এখনই তোমাদের রওনা হতে হবে। অস্ত্রাগার থেকে আমাকে এমএমজি দেওয়া হলো। অন্য বন্ধুদের দেওয়া হলো এসএলাার ও রাইফেল।  এমএমজির স্টান্ড ও গুলির চেইন বহনের জন্য আমার সাথে আরও ৪/৫ জনকে সাহায্যকারী হিসাবে দেওয়া হলো। ইনটেলিজেন্স অফিসারের নির্দেশ মোতাবেক ভোর ৫টার মধ্যে আমরা  যুদ্ধযাত্রা শুরু করলাম। দেশ মাতৃকার জন্য এটাই আমার জীবনের প্রথম যুদ্ধ। তাছাড়া কামালপুর ১১ নম্বর সেক্টরের শত্রুসেনাদের সব চেয়ে শক্ত ঘাটি।  এখানে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাই মনের উত্তেজনাকে কোন মতেই দমন করতে পারছিলাম না। সকাল ১১টার মধ্যে আমরা যথাস্থানে পৌছে গেলাম। একটি ক্ষেতের ২ ফুট উঁচু আল দেখিয়ে সেখানে আমাদের পজিশন নিতে বলা হলো। আমার এমএমজি স্টান্ডের উপর ফিট করা হতেই ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ এলো। আমিসহ সকল যোদ্ধা ভায়েরা একযোগে আক্রমণ শুরু কররাম। আমি এমএমজি মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শত্রুর ব্যারাকের দিকে অবিরাম গুলি ছুড়ছি। অল্প সময়ের মধ্যে শত্রুরাও আমাদের দিকে মর্টারের গোলা ও মেসিন গানের গুলি বর্ষণ শুরু করলো। আমি যেহেতু সবচেয়ে ভারী অস্ত্র এমএমজি ব্যবহার করছি, তাই আমি শত্রুর আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলাম। তাই জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতি মুহুর্তে আমাকে স্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছিল। বার বার স্থান পরিবর্তনের সময় হঠাৎ করেই আমার লুঙ্গি খুলে যায়।  লুঙ্গির শক্ত গিট দেওয়ার জন্য হাঁটু উচু করে দাড়াতেই শত্রুর একটা সেল ছুটে আসছিল আমার দিকে।  বন্ধু ইসহাক খান সতর্ক করতেই আমি কাঁদার মধ্যে শুয়ে পড়লাম। অল্পের জন্য আমার জীবন রক্ষা হলো। তারপর দীর্ঘ সময় যুদ্ধ  করার পর সেদিনের মতো আমাদের প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদান করা হলো।  এই যুদ্ধের বড় সাফল্য হলো শত্রুদের অনেক ক্ষতি করতে সক্ষম হলেও আমরা সবাই অক্ষত আছি।

কামালপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর জুলাই মাসে আমাদের রংপুর জেলায় ভেতরে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে আমরা একটা হাই স্কুলে সেল্টার গ্রহণ করলাম। সেখানে মাত্র ৩ দিন থাকার পর শত্রুর আক্রমণের মুখে আমরা ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা পায়ে হেঁটে আবার মহেন্দ্রপুর ক্যাম্পে ফিরে এলাম।  মহেন্দ্রপ৪ুর থেকে আমাদের সিরাজগঞ্জ এলাকার সকল মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রিত করে দেশের ভেতরে প্রেরণ করা হলো। দেশের ভেতরে এসে আমরা কাজীপুর থানায় সেল্টার গ্রহণ করি। সেখান থেকে অক্টোবর মাসে আমরা ভাটপিয়ার মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ এবং ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখে বেলকুচি থেকে সিরাজগঞ্জের দিকে পলায়নরত পাকসেনাদের উপর সর্বশেষ আক্রমণ পরিচালনার পর ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, তাইতো আমার হৃদয় সব সময় দেশপ্রেমে ভরপুর থাকে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।