গারো পাহাড়ের গদ্যে জিয়াউল হক

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুর রহিম

আমি মোঃ আব্দুর রহিম, নৌকমান্ডো, নৌকমান্ডো (কামরাঙ্গিরচর) গেজেট নম্বর-১৩৯, লাল মুক্তিবার্তা (লালবাগ) নম্বর-০১০১০৫০০২০, এমআইএস নম্বর-০১২৬০০০৪৫৩৩, মোবাইল নম্বর-০১৯১১০৩০৪২৯, পিতা ঃ আব্দুল কুদ্দুস, মাতা ঃ আফিয়া খাতুন, স্থায়ী ঠিকানা ঃ ৫৬০, নয়াগাঁও, আশরাফাবাদ, কামরাঙ্গিরচর ঢাকা-১২১১। বর্তমান ঠিকানা ঃ ঐ।
১৯৭১ সালে আমি ঢাকার নতুন পল্টন হাই স্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পর বাঙালিরা আশাবাদী হয়ে ওঠলো। এবার আর তাদের পশ্চিমা শাসকেরা শোষণ আর নির্যাতন করতে পারবে না। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোন মতেই বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি ছিল না। তাইতো শুরু হলো নানা টালবাহানা। ঠিক সেই সময়েই মাঠে এসে হাজির হলো পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টু। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর পার্টির নেতা হিসাবে তিনি ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দাবী করলেন। নিরং্কুশ সংখ্যাগরিষ্ট দল থাকার পর এই দাবী হাস্যকর হলেও তার আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশণ স্থগিত ঘোষণা করলেন। প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায় বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। সারা বাংলাদেশে শুরু হলো গণআন্দোলন। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম উল্লেখ করার সাথে সাথে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
২৫ মার্চ রাতে পাকসেনারা সারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করে মানুষ হত্যা শুরু করে। একই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরই পাকসেনাদের হাতে গ্রেফতার হলেন। তিনি গ্রেফতার হলেও তার ঘোষণা অনুযায়ী সারা বাংলাদেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকসেনারা তখন নানা ভাবে দেশের মানুষের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করে। দেশের এহেন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে এপ্রিল মাসের মাঝের দিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমি নিজ বাড়ি ছেড়ে বিক্রমপুর পদ্মাপাড়ের জসিদা লঞ্চ ঘাট থেকে লঞ্চে ফরিদপুরের টেকেরহাট, ঝিনাইদহ হয়ে যশোরের হাবাসপুর বর্ডার পার হয়ে ভারতের বনগাঁ ট্রানজিট ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি।
বনগাঁ ক্যাম্পে বেশ কয়েকদিন অবস্থানের পর বাংলাদেশ নৌকমান্ডো গঠনের উদ্দেশ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটা দল বনগাঁ ট্রানজিট ক্যাম্পে এসে হাজির হয়। তারা ক্যাম্পে উপস্থিত কয়েক হাজার যুবকের মধ্যে মাত্র আমাদের ৪৫ জনকে বাছাই করে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশি স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে নৌকমান্ডো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে অন্যান্য ক্যাম্প থেকে বাছাইকৃত সর্বমোট ৩০০ জনকে মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ৩ মাসের নৌকমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে নায়ায়নগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, মংলা ও খুলনা এই ৬ নৌবন্দরে আক্রমণ পরিচালনার জন্য আমাদের ১৫০ জন নৌকমান্ডোকে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়। আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে নৌবন্দরে জাহাজ ধ্বংসের জন্য প্রয়োজনীয় লিমপেট মাইন ও অন্যান্য অস্ত্রসহ ৬ গ্রুপ্রের নৌকমান্ডোদেরকে অপারেশনের স্থানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সারা বাংলাদেশে একই সময়ে অপারেশন পরিচালনার জন্য সকল কমান্ডো গ্রুপের টিম লিডারকে একটি ২ ব্রান্ডের রেডিও দিয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয় যে আকাশবানী রেডিও থেকে যেদিন থআমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গানথ গানটি বাজবে ধরে নিতে হবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আক্রমণ চালাতে হবে। থআমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়িথ গানটি বাজলে আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ছাড়তে হবে। এই সঙ্কেতের কথাা টিমলিডার ছাড়া আর কারো জানা ছিল না।
নারায়নগঞ্জ নৌবন্দরে অপারেশন ঃ নারায়নগঞ্জের নৌবন্দর আক্রমণ করার জন্য আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের ২২ জন নৌকমান্ডোকে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে নৌকাযোগে বাংলাদেশের ভেতরে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে আমরা নায়ায়নগঞ্জের বন্দর থানার জাঙ্গালিয়া গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করি। তারপর নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ১৫ আগষ্ট রাতে টিম লিডারের নির্দেশে আমরা বুকে লিমপেট মাইন বেঁধে নিয়ে অপারেশনে বের হই। তারপর নারায়নগঞ্জ নৌবন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজগুলোর মধ্যে ৫টি খাদ্য বোঝাই জাহাজের প্রত্যেকটিতে ৩টি করে লিমপেট মাইন স্থাপন করে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসার পর প্রচন্ড বিস্ফোরণে জাহারগুলো ডুবে যায়। একটা সফল অপারেশণ শেষে আমরা ভারতের আগরতলা ফিওে আসি।
নারয়নগঞ্জ সাইরোতে অপারেশন ঃ অক্টোবর মাসে আমরা ১২ জন নৌকমান্ডো আগরতলা থেকে নতুন করে মাইন সংগ্রহ করে আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করি। তারপর পূর্বের বন্দর থানার জাঙ্গালিয়া গ্রামেই সেল্টার গ্রহণ করি। অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে অপারেশনে বের হয়ে আমরা নারায়নগঞ্জ সাইলোতে অবস্থানকারী একটা ইউএনও জাহাজ ও অন্য একটি গম বোঝাই বিদেশী জাহাজে লিমপেট মাইন স্থাপন করে নিরাপদ দূরত্বে আসার পর তা বিস্ফোরিত হয়ে এই জাহাজ দুটিও নদীতে ডুবে যায়। নভেম্বর মাসে মাঝের দিকে আমরা ১৫ জন কমান্ডো কাঁচপুর ঘাটে পারাপারকারী ফেরিতে মাইন স্থাপন করলে তা বিস্ফোরিত হয়ে ফেরি ডুবে একটা ট্যাংকসহ ১০ জন সৈন্য নিহত হয়। একই ভাবে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা ২০ জন কমান্ডো মদনগঞ্জ ঘাটে ভিড়ে থাকা পাকসেনাদের একটি গানবোটে মাইন স্থাপন করে বিস্ফোরণ ঘটায়ে তা ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই। এই ভাবে আমাদের প্রতিটা অপারেশনই শতভাগ সফলতার মুখ দেখে। ১৬ ডিসেম্বর পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, তার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের সকলকে সবোর্চ্চ ত্যাগ স্বীকরের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।