আন্তর্জাতিক || পাক্ষিক পত্রপুট || এ জবা চৌধুরী (আটলান্টা)

বাংলাভাষার হাত ধরে

আজমৎ মিঞার জন্ম ঢাকা থেকে অনেক দূরে এক গ্রামে। তিনপুরুষের ভিটে। সাদামাটা ওই গ্রামের লোকেদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। সবাই এসে পাশে দাঁড়ায় প্রয়োজনে। এটা আজমৎ-এর কাছে খুব গর্বের ব্যাপার।

লেখা-পড়াটা তেমন বেশি হয়নি আজমৎ-এর। একাত্তরের যুদ্ধে, সে তখন বছর দশেকের, হারিয়েছে তার আব্বু-আম্মি আর ভাই-বোনেদের। প্রতিবেশীদের দয়ায় তার বড় হওয়া। একটু বড় হতেই বাড়ির পেছনে নিজের জমিতে চাষবাস করে শুরু হলো তার জীবনধারণ। যৌবনে পা দিতেই পাশের গ্রামের এক পরিবারের নজরে সে পড়ে আর বিয়ে হয়ে যায় ফরিদার সাথে।

বছর ঘুরে আসতেই ছেলে হলো। চোখে তখন তাদের অনেক স্বপ্ন। দেখতে দেখতে ছেলে জামাল বড় হলো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেলো। আর সেই থেকে আজমৎ-এর জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। বাবা-মা ইংরেজি জানে না বলে অশিক্ষিত ভেবে জামাল কাউকে তাদের পরিচয় দিতো না। স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র। একসময় বাড়িতে যাওয়াও বন্ধ করে দিলো। আজমৎ আর ফরিদা ফোন করে করে ক্লান্ত। একদিন ওরা ঢাকায় গিয়ে হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো ভোর থেকে। ছেলে কলেজে যখন যাবে –একটিবার দেখা করবে। জামাল সকাল ৯টা নাগাদ বেরোলো একদল বন্ধুদের সাথে। বাবা-মা’র দিকে চোখ পড়তেই মাথা ঘুরিয়ে নিলো। আজমৎ এর গলা যেন কে চেপে ধরেছে। কোনো শব্দ বেরোলো না তার গলা থেকে। একবার শুধু শক্ত করে ফরিদার হাতটা ধরলো।

তারপর আর মাস-খানেক। এরই মধ্যে বাড়ি-ঘর সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে বৌকে নিয়ে আজমৎ দুবাই চলে গেলো তার ভ্রাতৃসমান প্রিয়বন্ধুর কাছে। ছেলের কোনো খোঁজ সে আর করেনি। ফরিদার মায়ের মন কেঁদে উঠেছে বারবার। কিন্তু অকারণে ছেলের দেওয়া অপমান তাকে কষ্ট দিয়েছে অনেক বেশি। বন্ধুর বাড়িতেই থাকার বন্দোবস্ত হলো। কিন্তু কাজ না করলে জীবন চলবে কী করে?

দুবাইয়ে বাংলা স্কুল নেই। বন্ধুর পরামর্শে দু’জনে ঠিক করলো ফ্ল্যাটের একটা রুমকে ওরা দেশি বাচ্চাদের জন্য বাংলা শেখানোর স্কুল বানাবে। যেমন চিন্তা তেমনি কাজ।
আজ ওদের অনেক ছাত্র-ছাত্রী। আজমৎ আর ফরিদা দুজনেই পড়ায়। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসায় আজ ওদের জীবন পূর্ণ। বাংলাভাষার হাত ধরেই জীবন আজ বহু-সম্মানিত।

ওখানে ভালোবাসার মানুষেরা আর তাদের দেখে মুখ ফেরায় না।

Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!