T3 || কোজাগরী || বিশেষ সংখ্যায় জবা চৌধুরী

হ্যা গো শুনছো

অনেকদিন আগের কথা। মার্কিন মুলুকে তখন আমাদের জীবনের সবচে’ চ্যালেঞ্জিং চ্যাপ্টার চলছে। ফুলটাইম ছাত্রদের পরিবার যেমনটা চলে। নিউইয়র্কের ব্যস্ত সেসব দিনে মাথা তুলে আশপাশ দেখার কিছুটা সুযোগ মিলতো তখন সপ্তাহের ওই একটি দিন —রোববারে।

তখন আমার ম্যানহ্যাটনে দিনে দশ ঘন্টা করে সপ্তাহে ছ’দিন কাজ। রোববার মানে সেটা আমার বা আমাদের দিন। মাথাটা বেশ বোঝাহীন মনে হতো ওই রোববারেই। অবশ্য তারও আবার ছন্দপতন ঘটতো মাঝে মাঝেই। লাঞ্চের পর কুইন্সের একদল বন্ধুরা আসতো আমাদের এপার্টমেন্টে। কখনো আড্ডা, কখনও শুধুই আমরা হেঁটে বেড়াতাম এস্টোরিয়ার রাস্তায়। আমাদের কারোরই তখন গাড়ি ছিলো না।

যেদিন বন্ধুরা আসতে পারতো না, আমার বর সময়ের সদ্ব্যবহার করতে বইয়ের পাতায় ডুব দিতো। আর আমি আমাদের ষ্টুডিও এপার্টমেন্টের সাকুল্যে একখানামাত্র জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ভাবতাম ওই আকাশ ধরে কতদূর গেলে তবে আমাদের দেশ !

তবে নয়নবৌদিরা পাশের এপার্টমেন্টে আসার পর সব চিত্র পাল্টে গেলো। মনে হতো কে যেন গোটা বাংলাকে তুলে এনে আমাদের ঘরের দেওয়ালের ওপারে বসিয়ে দিয়েছে।

দিন হোক কী রাত — সেই একই উঁচু লয়ে কথা শুনতে শুনতে যখন মনে হতো নয়নবৌদি আমাদের অতি পরিচিত, তখন এক ছুটির দিনে ফাইন্যালি আসা-যাওয়ার পথের সিঁড়িতে সত্যিকরেই আমাদের পরিচয় বিনিময় হলো। মিষ্টি হেসে বৌদি বললো, “আমি নয়নতারা”l সাথের দাদাটি, “আ- আমি তারাপদ” — বলে ব্যস্ত পায়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়লো। বয়সে আমাদের থেকে বেশ খানিকটা বড় বলে সেই থেকে ওরা আমাদের নয়নবৌদি আর তারাদা।

মাত্র দুটো ফ্লোরের বিল্ডিং। মালিক ইটালিয়ান l নিচে মালিকের পিজ্জা রেস্টুরেন্ট, আর উপরে দুই বাঙালি ভাড়াটে পরিবার। উপরতলা মানেই এক্কেবারে চুপ একটি ঘর আর অন্যটিতে সারাদিনই হৈ হৈ উত্তেজনা।

সেদিনটা ছিল রোববার। প্ল্যান ছিল ইচ্ছে-ঘুমে সকালটা বিছানায় গড়িয়ে সৌখিনতা করার। সে আশায় জল ঢাললো নয়নবৌদির হঠাৎ চিৎকার।

–” ঐটুকুনি বাচ্চা আমাকে ‘মনস্টার’ ডাকলো!” বলতে বলতে বড় বড় পায়ে সিঁড়ি পেরিয়ে বেশ বড়সড় ফিগারের নয়নবৌদি দরজা ঠেঁলে ওদের ঘরে ঢুকলো। বৌদির রাগের নমুনা সহ্য করতে না পেরে ধাক্কা খেয়ে বিশাল শব্দ করে বন্ধ হলো ওদের দরজাটা। ঘুমের বারোটা! আমি আর আমার বর করুণ চোখে তাকালাম একে অন্যের দিকে।

পরে সবিস্তারে জানা গেলো পুরো গল্প। আমাদের এপার্টমেন্টের ঠিক উল্টোদিকে ছিলো বেশ বড় এক সবজি বাজার। আর ওই বাজারের মালিক ছিল এক গ্রীক ভদ্রলোক। আসলে এস্টোরিয়ার ওই দিকটায় প্রচুর গ্রীক লোকেরা থাকতো সেই সময়।

সদ্য দেশ থেকে আসা আমাদের নয়নবৌদি সকাল সকাল বাজারে গিয়ে বছর তিনেকের এক গ্রীক বাচ্চাকে “কিউট বয়” বলে তার কোঁকড়ানো চুল হাত দিয়ে একটু নাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সময়ে আমাদের দেশে অমনটা খুব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নিউইয়র্কে অচেনা কারোর ওরকম আদর কেউ সু-চোখে দেখতো না। বাচ্চা ছেলেটি তার মায়ের পেছন পেছন হাঁটছিলো। হঠাৎ ওর মা’কে ডেকে বললো, ” Mom, she is a monster!” ব্যস, রেগেমেগে বাজারের জিনিস ওখানেই ফেলে রেখে নয়নবৌদি ফিরে এলো ঘরে।

নয়নবৌদিকে নিয়ে মাঝে মাঝেই ঝড় উঠতো। এমন সব মন্তব্য করে বসতো যেখানে সেখানে যে অন্যরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়তো। এর কোনো সমাধানের পথ না পেয়ে একদিন তারাদা বৌকে ডেকে বললেন, “নয়ন, চট করে কাউকে কিছু বলার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে নিও।”

সেই থেকে শুরু। তারপর থেকে কাউকে কিছু বলার আগে নয়নবৌদি “হ্যা গো শুনছো —” বলে তারাদাকে প্রথম সব বলে নিতো।

একদিন আমার এক বান্ধবীকে চা-এ ডেকেছিলাম। বাইরে থেকে বৌদির গলা শোনা গেলো, “খুব সুন্দর চায়ের গন্ধ বেরোচ্ছে। আমরা আসছি।” একটু বাদেই নয়নবৌদি আর তারাদা এসে হাজির। বান্ধবীটিও বাঙালি। আড্ডা জমে গেলো অল্প সময়েই। হঠাৎ বৌদি আমার বান্ধবীটির বয়স জানতে চাইলো। একটু অবাক হলেও বান্ধবীটি বললো ওর বয়স। প্রশ্ন ওখানেই থামলো না।

নয়নবৌদি — “আর মাধ্যমিক কোন ইয়ারে?”

বান্ধবীটি প্রশ্নের ধরন বুঝতে না পেরে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে তারও জবাব দিলো।

সাথে সাথেই বৌদি তারাদাকে ডেকে “হ্যা গো শুনছো — ওর বয়স ঠিকই বলেছে তাই না?”

আমরা তো ‘থ’! আমি বেশ ভয়ও পেলাম। একটাই মাত্র ভালো বন্ধু জুটেছিলো — সেও হয়তো রেগে গিয়ে আর যোগাযোগ রাখবে না।

সে বার আমরা অনেকে দল বেঁধে নিউইয়র্কের ‘কুইন্স’এর দুর্গাপুজো দেখতে গেলাম। দেশের অনেক নামকরা গায়ক, গায়িকারা আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। অনুষ্ঠান শেষে আমার খুব প্রিয় একজন শিল্পীর সাথে কথা বলছি, হঠাৎ করে নয়নবৌদি সেখানে হাজির। কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলে বসলো,”দাদা, ভালো গেয়েছেন। আরও প্র্যাকটিস করলে গলা আরও ভালো হবে।” শুনে আমি আর সেই শিল্পী, দু’জনই স্তব্ধ।

এক প্রতিবেশীর মেয়ে সে বার ‘সেরা সুন্দরী’ ট্যালেন্ট শো তে প্রথম হয়েছে। আমরা দেশিরা অনেকে গেলাম ওকে অভিনন্দন জানাতে। ঘর ভর্তি মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে, সামনে টেবিলে রাখা ক্রাউন, সার্টিফিকেট, নিউসপেপারে আসা খবর, নানা ছবি এবং মেয়েটির বাবা-মায়ের খাবার-দাবারের আয়োজন উপেক্ষা করে বেশ উঁচু গলায় তারাদাকে ডাকলো, “হ্যা গো শুনছো–!”

তারাদা সামনে আসতেই বললো, “ও কি করে ‘সেরা সুন্দরী’ হলো, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না!”

তারাদা সেদিন আর এক মিনিটও সেখানে না দাঁড়িয়ে বৌদিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

কয়েকমাস পর আমরা নিউইয়র্কের Long Beach এ মুভ করে গেলাম। সেই থেকে নয়নবৌদি আর তারাদা’র সাথে দেখা হয়নি।

গতবছর শীতের ছুটিতে দেশে গিয়ে কলকাতার নিউ টাউনের এক মল’এ আমরা আমাদের মেয়ের জন্য ড্রেস পছন্দ করছি , হঠাৎ পরিষ্কার শুনলাম কেউ একটা বললো, “হ্যা গো শুনছো — কী গলাকাটা দাম চাইছে ! ফিক্সড প্রাইস’ লিখে রেখেছে বলে কি দামদর করা-ই যাবে না?”

আমি আর আমার বর একে অন্যের দিকে তাকালাম, ধীরে ধীরে আমাদের চোখগুলো বড় হলো। কঠিন ধাঁধার উত্তর মিলে যাবার মতো একটা খুশি ছড়িয়ে পড়লো আমাদের চেহারায়। দু’জনেই মাথা ঘোরালাম যেদিক থেকে কথাটা আসছিলো। স্থান,কাল ভুলে দু’জনেই একসাথে ডেকে উঠলাম, “নয়নবৌদি”!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।