• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১৫)

যুদ্ধ যুদ্ধ

পনেরো

আজ গৃহপ্রবেশ হল মানুষটার।বেশ ঘটা করেই।পুজো, আচার অনুষ্ঠান ঠিকঠাক মেনে। মানতেই হয়েছে মানুষটাকে। একরকম শ্মশানের মধ্যে বসবাস বলে কথা। ভুতপেত্নি থাকতেই পারে। ঘর শুদ্ধ করে বসবাস না করলে সে ঘর আর মানুষের বসবাসের জন্য থাকে না।যেমন করেই হোক তাড়িয়ে দিয়ে তেনারাই বসবাসের জন্য দখল নেন। আগের ওই ল্যাংড়া সাধু হয়ত ওই ভয়েই গ্রামছাড়া হয়েছে। সেই ভাঙ্গাচোরা পুরানো ঘরটা এখন শক্তপোক্ত, ঝকঝকে তকতকে, সুন্দর। গৃহপ্রবেশের পুজোআর্চার সমস্ত খরচ বসতির মানুষগুলো কিছুটা জোগাল। অধিকাংশটা মুকুন্দ পোদ্দার। সেইসঙ্গে একটা চৌকি, বিছানাপত্র, থালাবাসন, উনুন একটা আর কিছু জামাকাপড় কিনে দিল মুকুন্দ পোদ্দার। ঘরে জিনিসপত্র বলতে ছিল একটা সিঁদুরমাখা পাথর, পাশে গাঁথা একটা মরচে ধরা ত্রিশূল আর শুকনো ফুলবেলপাতা। মুকুন্দ পোদ্দারের সঙ্গে বাজারকমিটির কয়েক জন সদস্যও এসেছে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে। এই উপলক্ষে আরও একটা কাজ সেরে রাখতে চায় মুকুন্দ পোদ্দার, শ্মশানের জলার পাশের পতিত জমিটা বসতির পরিবারগুলোর মধ্যে কিভাবে বন্টন করা যায় তার একটা ব্যবস্থা করা। জমি সবাই সমান ভাগে পাবে। ঘর তোলার টাকা দেবে বাজার কমিটি। এখন প্রশ্ন হল, জমি বন্টনের পদ্ধতিটা কী হবে। বাজারকমিটি নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্টন করবে নাকি এই নিয়ে বসতির মানুষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাজারকমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্টন হলে বন্টিত প্লটের পজিশান দেখে সকলে সন্তুষ্ট নাও হতে পারে। ফলে দয়ালের প্রতি অনেকের ক্ষোভ জন্মাতে পারে। ভাবতে পারে, এসব দয়ালেরই কারসাজি। দয়াল তাই তার সিদ্ধান্ত জানাল, লটারি হবে। প্লটগুলোর নাম্বারিং করে সেগুলো নিয়ে লটারি হবে। যে যেই নাম্বার তুলবে সেটাই তার প্লট হবে।
শুনে খুশি হল মুকুন্দ পোদ্দার। এতে করে কারও কোনও ক্ষোভ অভিমান থাকার কথা নয়। বলল, উত্তম প্রস্তাব!
কমিটির আর সদস্যরাও তার কথায় সায় দিল। তারপর তারা আরও গোপন আলোচনা শুরু করল। একসময় মুকুন্দ পোদ্দার বলল, শোন দয়াল, তোমরা যে স্বধর্মে ফিরে আসছ সে কথাটা এখনই রাষ্ট্র করা যাবে না। তাহলে মিশনবাড়ি থেকে বাধা আসতে পারে।বাধা বলতে মারদাঙ্গা তো আর নয় ভাল ভাল প্রলোভনের টোপ। যা খেটে খাওয়া বসতির গরীব মানুষগুলোর পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হতে পারে। ওদের বিদেশী টাকার অভাব নেই। এমন লোভনীয় প্রস্তাব দিল যে বসতির মানুষগুলোর মন ঘুরে গেল। তাহলে যে সব আয়োজন পয়মাল হয়ে যাবে। সুতরাং, খুব সাবধান। আগে পতিত জমিটা মাটি ফেলে উঁচু করা দরকার।দড়ি ফেলে দাগ মেরে প্লট ভাগ করতে হবে। একজন ভালো আমিন ডাকতে হবে। যেদিন তোমরা স্বধর্মে ফিরবে সেদিনই লটারি করে প্লট বন্টন করা হবে। নতুন ঘরে নতুন করে জীবন শুরু করবে তোমরা। তারপর মুকুন্দ পোদ্দার মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, তা গোঁসাই, এদের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে হবে শুনি? শাস্ত্র মতে হবে তো নাকি? কৌতূহলী হয় মুকুন্দ পোদ্দার।
আপনে হাসাইলেন কত্তা, এই পান্ডববজ্জিতের দেশে শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত এমন কে আছে যে সঠিক প্রাচ্চিত্তের বিধান দিব! এখানে আমি যা কমু সেইটাই বিধান হিসাবে মাইনা নেন। হরিনাম সংকীর্তনেই বসতির মানুষগুলার সব পাপ ধুইয়া মুইছা যাইব। নতুন বসতিতে আটরাত্র নামকীর্তনের আয়োজন করেন আপনে। জয় যীশুখিষ্টর বদলে ওদের গলায় হরে রাম হরে কৃষ্ণ ধ্বনি ফিরা আইব। খোলকর্তাল বাজাইয়া নামসংকীর্তন করতে করতে বসতির বেবাক মানুষ নদীতে যাইব। মাইয়ামানুষ আর ছোটরা নদীতে সিনান কইরা নতুন ঘরে উঠব। আর পুরুষরা নদী সাঁতরাইয়া ওপারে গিয়া উঠব। তাতেই ওদের পাপের নদী পার হওন হইয়া যাইব। তারপর হইব আসল প্রাচ্চিত্তের কাজ। তারজন্য উপাচার যা লাগব তার একটা ফদ্দ করন লাগব। দন্ডও ধার্য হইব।
মুকুন্দ পোদ্দার বলল, থানার বড়বাবুকে বলে কজন পুলিশের ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও এই দেশে আমরাই মেজরিটি, তবুও ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ছুতোনাতায় রাজনৈতিক ফায়দা তোলার লোকেরও তো অভাব নেই। তবে আমি থাকতে সহজে ওসব হতে দেব না। আটঘাট বেঁধেই এই কাজে নামব। বিধর্মী হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে স্বধর্ম ফিরিয়ে আনার কাজে নেমেছি। এ হল পবিত্র কাজ।
কমিটির একজন সদস্য মুকুন্দ পোদ্দারের কথায় সায় দিয়ে বলল, শাস্ত্র মতে প্রায়শ্চিত্ত করিয়েই যে ওদের স্বধর্মে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে তার সাক্ষী হিসাবে পাঁচগ্রামের কয়েকজন গন্যমান্য মানুষ ওইদিন উপস্থিত থাকবেন।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ওদের গোপন বৈঠক সাঙ্গ হল।
রাতে নতুন হ্যারিকেনের আলোয় বসে প্রায়শ্চিত্তের ফর্দ তৈরি করছে মানুষটা। সবৎসা কৃষ্ণা গো বা মূল্য একশত টাকা, গামছা ২, দুগ্ধ ১ সের, সরা ৪,তিল,গব্যঘৃত ২ পোয়া, মধু, বাতাসা, কাঁঠালি কলা ১ ফানা, কম্বল ১,মৃৎপাত্র ১০,আতপতন্ডুল ৫ সের, পাঁকাটি, প্রদীপ ৫,কলাপেটো ৫,শয্যাদ্রব্য,ছাতা,খড়ম,গঙ্গাজল, গঙ্গামাটি, ধূপ, দীপ, পুষ্প, ব্রাহ্মণভোজন, উপযুক্ত দক্ষিণা। এই পর্যন্ত লিখে মানুষটা থামল। বাকি আরও যা যা আছে ধীরে ধীরে তা সবই তার মনে পড়বে। এখন শরীরটা ক্লান্তিতে কেমন যেন ছেড়ে আসছে। নাকি নতুন বিছানার ওম পেতেই বুঝি শরীরটা সে বিছানায় এলিয়ে দিল। অদ্ভুত এক আরাম বোধ করছে মানুষটা। ঘুম আসার আগে পারুর কথা মনে পড়ছে তার। পারুকে পেতে হলে তাকে জাত আর বর্ণের বিপর্যয় ঘটিয়ে নীচে নামতে হবে। মানুষটা মনে মনে নিজেকেই যেন প্রবোধ দিয়ে বলে, সে হোক! এই দেশে এসে ওই দেশের কে আর তার খোঁজখবর নিচ্ছে! শিষ্যঘর আত্মীয়পরিজন সব যে কে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে তার আর হিসেবনিকেশ নেই। দেশভাগ, যুদ্ধে জীবন বন্যায় ভেসে চলা খড়কুটো। বসতির মানুষগুলো ছাড়া এই দেশে তার আর সাতকুলের কে আছে। এদের মধ্যে থেকে এদের নিয়েই তাকে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে নতুন বাঁধা গানটা মনে পড়ে তার। তাতে সুর দেওয়ার চেষ্টা করে। চেষ্টা করতে করতে কখন তার কন্ঠের গুনগুন মৌমাছির ডানা থেমে যায়। চোখজোড়া মুদে আসে।স্বপ্নে পারুকে ধরার আশা নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।