|| বিদ্যাসাগর || ক্যাফে স্পেশালে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ণে বিদ্যাসাগর – ‘ভূষণহীন সারল্যই তাঁহার রাজভূষণ’

“বঙ্গভারতীর ভালে পরালো প্রথম জয়টিকা।
রুদ্ধভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা,
হে বিদ্যাসাগর, পূর্ব দিগন্তের বনে-উপবনে
নব উদ্বোধনগাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে”।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন যথাযথ। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের এরূপ আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয় কেন, বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।… বিদ্যাসাগরের চরিত্রসৃষ্টিও রহস্যাবৃত; কিন্তু ইহা দেখা যায়, সে চরিত্রের ছাঁচ ছিল ভালো। …. সেইজন্য বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাহার স্বজাতি সোদর কেহ ছিল না। এ দেশে তিনি তাহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন”।
রবীন্দ্রনাথের তখন চলছিল ‘ঘরের পড়া’। খগেন্দ্রনাথের বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, “পাঁচবছর পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাশিক্ষার আরম্ভ। ঠাকুরবাড়ির পূজোর দালানে ছিল ঠাকুরবাড়ির পাঠশালা বা ইস্কুলঘর। সম্ভবত এখানেই রবীন্দ্রনাথের পড়াশুনা শুরু। তার গৃহাশ্রিত গুরুর নাম ছিলো মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রনাথের বর্ণপরিচয়”।
ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলের পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৮৬৫’র পূজার পর থেকে ১৮৬৬’র গোড়া পর্যন্ত আনুমানিক ৬ মাস রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনা গৃহস্থ গুরুমশাইয়ের কাছেই হয়েছিল। এ সময়কার গৃহশিক্ষকদের মধ্যে যার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। তিনি হলেন নর্মাল স্কুলের নীলকমল ঘোষাল। নীলকমল বাবু হয়তো স্কুলের নির্দিষ্ট পাঠক্রমের বাইরে বহু বিষয়ই ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “চারুপাঠ বস্তুবিচার, প্রাণীবৃত্তান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া মাইকেলের মেঘনাথবধ কাব্য পর্যন্ত ইহার কাছে পড়া।’ এছাড়া পড়েছেন বর্ণপরিচয়, বোধোদয়, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি”।
এছাড়াও জোড়াসাঁকোর বাড়িতে শিক্ষকেরা আসতেন নিয়ম করে এবং তার ব্যতিক্রম হত না বলে দুঃখ হত খুব। বৃষ্টির দিনেও দেখা যেত সমস্ত প্রত্যাশা ভঙ্গ করে “দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়াছে।” এঁদেরই একজন রামসর্বস্ব পণ্ডিত যিনি একই সঙ্গে ছিলেন ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমী’ তথা মেট্রোপলিটান স্কুলের শিক্ষক এবং রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহশিক্ষক। তাঁর উৎসাহে তাঁরই সঙ্গে “ম্যাকবেথের” অনুবাদ শোনাতে বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ, যার উল্লেখ রয়েছে ‘জীবনস্মৃতি’তে। এই স্কুলের সভাপতি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
‘জীবনস্মৃতি’র বর্ণনা অনুযায়ী, জীবনের সেই পর্বে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের “শিশুশিক্ষা-১” ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম ‘প্রাইমার’, পাশাপাশি, বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়-১ম ভাগও যে পাঠ করেছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে নিজের লেখাতেই। “কেবল মনে পড়ে, “জল পড়ে পাতা নড়ে।” তখন “কর, খল” প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কুল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি, “জল পড়ে পাতা নড়ে।” আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা”।
অবশ্য ঠিক এই কথাগুলি এই ভাবে বিদ্যাসাগর লেখেননি। তৃতীয় পাঠে ‘জল পড়ে’ কথাটি থাকলেও ‘পাতা নড়ে’ কোথাও লেখা নেই, বরং আছে ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’। বর্ণযোজনা শিখতে গিয়েই ‘বর্ণপরিচয়’ পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং পরিচিত হয়েছিলেন শব্দগুলির সঙ্গে। রবীন্দ্র গবেষক প্রশান্ত পালও জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’- এটাই পড়েছিলেন, কিন্তু “ভাবী মহাকবির ‘সমস্ত চৈতন্য’ গদ্যের সেই সাদাসিধে রূপের অন্তরে নিহিত ছন্দটুকু আবিস্কার ক’রে গদ্যের ঘটমান বর্তমানকে কবিতার নিত্য বর্তমানে পরিণত করেছে।” অনেক পরে লেখা একটি গানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে,
মন্ত্র তোমার মন্দ্রিত সব ভুবনে”॥
কে জানে, বিদ্যসাগরের কথাও মনে ছিল কি না!‎ সীতার বনবাস, শকুন্তলা, বেতাল পঞ্চবিংশতি, বোধোদয়— এইসব বইয়ের মধ্য দিয়ে যে বিদ্যাসাগরকে সেই বালক কালে পাশে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার অনুরণন ছিল আজীবন। ঘরের পড়ার সেই যুগে অনেক কিছুই মনে হত অত্যাচার, কিন্তু তার পাশাপাশি মুগ্ধতাও জাগিয়ে রেখেছিলেন কেউ কেউ। তাঁদের সবার আগে ছিলেন বিদ্যসাগর। শিল্পীর কলমে লেখা বলে তাঁর বইগুলি কেবল বই হয়ে নয়, ছবি ও গান হয়ে ধরা পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ চেতনায়।
বিদ্যাসাগরের সাথে রবীন্দ্রনাথের একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৮৮২ সালে, বিদ্যাসাগরের কলকাতার বাড়িতে৷ একটি সাহিত্য–সমিতি (সারস্বত সমাজ) করার উদ্যোগ নিয়ে এবং সেই সমিতিতে বিদ্যাসাগরকে থাকতে বলার আবেদন নিয়ে তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন৷ বিদ্যাসাগর তাঁদের সব পরিকল্পনা শুনে বলেছিলেন, ‘‘ভাল উদ্যোগ৷ কিন্তু আমার অনুরোধ, হোমরাচোমরাদের এর মধ্যে রেখো না৷ ওতে কাজ পণ্ড হয়৷’’ ঘটনাচক্রে সত্যিসত্যিই সে সমিতি কিছুদিনের মধ্যে উঠে গিয়েছিল৷
আরেকবার, রবীন্দ্রনাথ তখন ম্যাকবেথ–এর কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করেছেন৷ তাঁর ইংরেজির গৃহশিক্ষক বললেন, “চলো, অনুবাদটা বিদ্যাসাগর মশাইকে দেখিয়ে আসা যাক৷” শিক্ষক মহাশয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ একদিন গেলেন বিদ্যাসাগরের কাছে৷ ‘জীবনস্মৃতি’–তে সেদিনের কথা স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ তাতে লিখেছেন, “রামসর্বস্ব পণ্ডিতমশায়ের প্রতি আমাদের সংস্কৃত অধ্যাপনার ভার ছিল। অনিচ্ছুক ছাত্রকে ব্যাকরণ শিখাইবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় ভঙ্গ দিয়া তিনি আমাকে অর্থ করিয়া করিয়া শকুন্তলা পড়াইতেন। তিনি একদিন আমার ম্যাকবেথের তর্জমা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শুনাইতে হইবে বলিয়া আমাকে তাঁহার কাছে লইয়া গেলেন। তখন তাঁহার কাছে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বসিয়া ছিলেন। পুস্তকে-ভরা তাঁহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরুদুরু করিতেছিল— তাঁহার মুখচ্ছবি দেখিয়া যে আমার সাহস বৃদ্ধি হইল তাহা বলিতে পারি না। ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই— অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল। বোধ করি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম”। এই দু’বার ছাড়া বিদ্যাসাগরের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ সম্ভবত আর হয়নি৷
১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন৷ উল্লেখযোগ্য ভাবে, সে বছরই মে মাসে রবীন্দ্রনাথ ‘দেনাপাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’–এর মতো ছোটগল্প লিখে প্রকাশ করছেন৷ সমাজে নারী জীবনের উপর কত বড় নিপীড়ন চলছে রবীন্দ্রনাথ তা দেখাচ্ছেন কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়ে৷ বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ–সংবাদ আসার পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশ করা হল ‘‘বিদ্যাসাগর রচিত ‘আত্মজীবনচরিতের’ কয়েক পৃষ্ঠা’’ শীর্ষক লেখা৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘এই সংখ্যায় (কার্তিক, ১২৯৮) বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আত্মজীবনচরিতের কয়েক পৃষ্ঠা বাহির হইয়াছে৷ ইহাতে অলঙ্কারবাহুল্য বা আড়ম্বরের লেশমাত্র নাই৷ পূজনীয় লেখক মহাশয় সমগ্র গ্রন্থটি শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই বলিয়া মনে একান্ত আক্ষেপ জন্মে৷ এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হইলে বাঙ্গালীদের পক্ষে শিক্ষার স্থল হইত৷’’ ১৮৯২ সালে ‘সাহিত্য’ পত্রিকাতেই প্রথম ছাপা হয় বিদ্যাসাগরের ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’৷ লেখাটি পড়ার সাথে সাথেই রবীন্দ্রনাথ ‘সাধনা’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘‘স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় রচিত এই প্রবন্ধটি পাঠ করিলে হৃদয় করুণারসে আর্দ্র না হইয়া থাকিতে পারে না৷’’
১৮৯৫ সালের ২৯ জুলাই কলকাতার বিডন স্ট্রিটে এমারেল্ড থিয়েটার (১৮৮৭–১৮৯৬) মঞ্চে বিদ্যাসাগর স্মরণে এক বিশাল সভা আয়োজন করা হয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৩৪৷ তিনি ওই স্মরণসভায় এক প্রবন্ধপাঠের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মসাধনার বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং পরের মাসেই (ভাদ্র–কার্তিক ১৩০২) সেটি ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ বিদ্যাসাগর–চরিত্রের্ গভীরতা প্রসঙ্গে অনন্যসাধারণ বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ওই প্রবন্ধের শেষ বাক্যে বলেছেন, ‘‘…দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব…৷’’
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যসাগরচরিত প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন৷ তৎপূর্বে বাংলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন৷ ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধারমাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন–তেন–প্রকারেণ কতকগুলা বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্যসমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন৷ তিনি দেখাইয়াছিলেন যে যতটুকু বক্তব্য তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে৷… একটি অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া সৌম্য ও সরল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন৷ বিদ্যাসাগরের দান বাংলা ভাষার প্রাণপদার্থের সঙ্গে চিরকালের মতো মিলে গেছে, কিছুই ব্যর্থ হয়নি৷’’
ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদ্যাসাগরের চিন্তার সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথ জীবনের নানা পর্বে প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছেন৷ আলোড়িত হয়েছে তাঁর দেশ–কাল ভাবনা, শিক্ষা ভাবনা, সমাজ ভাবনা৷ যে রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত সামাজিক প্রভাবে একসময় বাল্যবিবাহ, বর্ণপ্রথা ইত্যাদি দেশাচারের সমর্থক হয়ে পড়েছিলেন, সতীদাহ এবং নারীর চিরবৈধব্যকে প্রাচীন ভারতের গর্বের বিষয় বলে মনে করতেন, (সূত্র : ‘মাভৈঃ’ এবং ‘সমাজভেদ’ নিবন্ধ) সেই রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে এগুলি কাটিয়ে উঠেছেন৷ শিরোপা গ্রহণের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের আচরণে দেখা যায় বিদ্যাসাগরেরই ছায়া৷
বিদ্যাসাগরকে সরকার সিআইই দিতে চাইলে তিনি তা এড়াতে কিছু দিন কলকাতার বাইরে গিয়ে কাটিয়েছিলেন৷ পরে বাড়ি বয়ে সেই পদক দিতে এসে রাজকর্মচারীরা যখন বখশিস চেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “ওই স্বর্ণপদক বেনের দোকানে বেচে যা পাবে নিয়ে নাও৷’
আর, রবীন্দ্রনাথের হাতে যখন নোবেল প্রাপ্তির টেলিগ্রাম এল, তিনি শান্তিনিকেতনের সচিবের হাতে সেই টেলিগ্রাম দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই নিন, নেপালবাবু, আপনার নালা তৈরির খরচ৷’
১৯৩৯ সালে মেদিনীপুরে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির’ উদ্বোধন করে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলেন ৭৮ বছরের রবীন্দ্রনাথ৷ নোবেলজয়ী বিশ্বকবি বলেছিলেন, ‘‘বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷’’
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ভূষণহীন সারল্যই তাঁহার রাজভূষণ ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র যখন কলিকাতায় অধ্যয়ন করিতেন তখন তাঁহার দরিদ্রা ‘জননীদেবী চরখায় সূতা কাটিয়া উভয় পুত্রের বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া কলিকাতায় পাঠাইতেন।’ সেই মোটা কাপড়, সেই মাতৃস্নেহমণ্ডিত দারিদ্র্য তিনি চিরকাল সগৌরবে সর্বাঙ্গে ধারণ করিয়াছিলেন। তাঁহার বন্ধু তদানীন্তন লেফটেনেন্ট গবর্নর হ্যালিডে সাহেব তাঁহাকে রাজসাক্ষাতের উপযুক্ত সাজ করিয়া আসিতে অনুরোধ করেন। বন্ধুর অনুরোধে বিদ্যাসাগর কেবল দুই-একদিন চোগা-চাপকান পরিয়া সাহেবের সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলেন। কিন্তু সে লজ্জা আর সহ্য করিতে পারিলেন না। বলিলেন, ‘আমাকে যদি এই বেশে আসিতে হয়, তবে এখানে আর আমি আসিতে পারিব না।’ হ্যালিডে তাঁহাকে তাঁহার অভ্যস্ত বেশে আসিতে অনুমতি দিলেন। ব্রাহ্মণপণ্ডিত যে চটিজুতা ও মোটা ধুতিচাদর পরিয়া সর্বত্র সম্মানলাভ করেন বিদ্যাসাগর রাজদ্বারেও তাহা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন নাই”।
তারপর সূদীর্ঘ কাল ধ’রে সেই মুগ্ধতা লুকিয়ে ছিল মনে গহনে। না, বিহারীলাল নন, বঙ্কিমচন্দ্র নন, মধুসূদন তো একেবারেই নন, শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকেই গুরুর ভূমিকায় বরণ ক’রে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ কোনও সাময়িক আবেগের তাৎক্ষণিক প্রকাশ নয়। একটু সন্ধান করলেই দেখব, এর মধ্যেও রয়েছে ধারাবাহিকতা। রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর-মূল্যায়ণে সবচেয়ে চেনা কথাগুলির প্রথমেই আছে বাংলা গদ্যের স্থপতিকে স্মরণ “তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।… তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।… বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন। .. তাঁর শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ ছিল।”
শিল্পীমনের এই যোগসূত্রটি স্মরণ করে কবিতাও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ:
“ভাষার প্রাঙ্গণে তব আমি কবি তোমারি অতিথি
ভারতীর পূজা তরে চয়ন করেছি আমি গীতি”
বিদ্যাসাগর রচনাবলির প্রথম খণ্ডটি রবীন্দ্রনাথের হাতে আসে কালিম্পং প্রবাসে, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে (১৯৩৯)। খুশি হয়ে একটি চিঠি লিখেছিখেন মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিনয়রঞ্জনকে, “বিদ্যাসাগরের বেদীমূলে নিবেদন করার উপযুক্ত এই অর্ঘ্য রচনা।”
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘ক্ষুধিত–পীড়িত অনাথ–সহায়দের জন্য আজ তিনি বর্তমান নাই৷ কিন্তু তাঁহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয়বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালিজাতির তীর্থস্থান হইয়াছে৷ আমরা সেইখানে আসিয়া আমাদের তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা, নিষ্ফল আড়ম্বর ভুলিয়া– সূক্ষ্মতম তর্কজাল এবং স্থূলতম জড়ত্ব বিচ্ছিন্ন করিয়া– সরল সবল অটল মাহাত্ম্যের শিক্ষা লাভ করিয়া যাইব”৷’
’সত্যি, আগে কখনও মনে হয়নি, বিদ্যাসাগরের ছায়া এতটা দীর্ঘ ছিল রবীন্দ্রনাথের উপরে!
ঋণ: বিদ্যসাগরচরিত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্ররচনাবলী। রবীন্দ্রজীবনী – প্রশান্তকুমারপাল। ইন্টারনেট
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।