গান্ধী জয়ন্তী উপলক্ষে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

বাঙালির প্রেমে কবিতার ফ্রেমে তুমি বাপু জী

শুভ জন্মদিন গান্ধীজী

সাহিত্য মনের দর্পন। সাহিত্য সমাজের দর্পন। মহাত্মা গান্ধীর ক্ষেত্রে এক নূতনতর সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে যা ‘গান্ধী সাহিত্য’ নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। কেবল বিশ্বের সবকটি ভাষাতেই নয়, সম্ভবত গান্ধীজী তাঁর জীবন, কর্ম কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা নিয়ে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে তা এখনি বিস্ময়কর সংখ্যায় পৌঁছে গেছে ও প্রায় প্রতিদিনই সাহিত্যর বিভিন্ন মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটছে। গান্ধীজী নিজেই অবশ্য বড় সাহিত্যিক ছিলেন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতই সূর্যের নীচে যা কিছুই আছে সেই সব বিষয়ে অফুরন্ত লিখেছেন। অবশ্য সাহিত্যিক বা লেখক পরিচিতি তিনি কোনদিনই দাবী করেননি।
মহাত্মা গান্ধী উনবিংশ শতকের শেষ পর্বে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় নীপীড়িত মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার স্থাপনে যখন আন্দোলন করছেন তখন আন্দোলনের অভিনবত্বে ‘গান্ধী-চরিত’ সম্পর্কে বাংলার কিছু কবি-সাহিত্যিক, যেমন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং আরও অনেকের কবিতা ও অন্যবিধ রচনায় প্রকাশ পেয়েছে
“শুরু হল নতুন নাট্য সূত্রধরের নূতন নাট
সাগর-পারে গান্ধী করে জাতীয়তার নান্দী পাঠ”। – 
(সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২): বাংলা কাব্যজগতে ছন্দের জাদুকর নামে পরিচিত। তাঁকে ছন্দোরাজও বলা হয়। তাঁরই সম্পাদনায় ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় ‘গান্ধী মাহাত্ম্য’ সিরিজের প্রথম পুস্তক ‘গান্ধী-কীর্ত্তন’। গান্ধীজীর যোগ্য নেতৃত্বের দ্বারাই যে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান ঘটবে সে বিষয়ে তিনি নিঃসংশয় ছিলেন। তিনি গান্ধীজীর চরকা ব্রতের প্রবল সমর্থক ছিলেন। গান্ধীজী চেয়েছিলেন ‘to wipe every tear from every eye’ এবং এই কারণেই তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের উপযোগী কাজ হিসাবে চরকা কাটার কথা বলেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ গান্ধীজীর এই বক্তব্যকে সঠিক বলে মনে করেছেন এবং সমগ্র বাংলায় চরকা প্রথার প্রচলন চেয়ে লিখেছেন ‘চরকার গান’ কবিতা।
“আর নয় আইঢাই ঢিস্-ঢিস্ দিন ভর
শোন্ বিশকর্মার বিষ্ময় মন্তর!
চরকার চর্যায় সন্তোষ মনটায়,
রোজগার রোজদিন ঘন্টায় ঘন্টায়!
চরকার ঘর্ঘর বস্তির ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর মঙ্গল, – আপনায় নির্ভর!
বন্দর-পত্তন হঞ্জে সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া”!
দক্ষিণ-আফ্রিকার কুলি-পল্লীতে সেবাব্রতী, বুয়ার-যুদ্ধে মিত্রশক্তির সৈনিক ইত্যাদি সকল রূপেই গান্ধিজীর চিত্র নির্মাণ করেছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন গান্ধিজীর অহিংস মূর্তিকেই।অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের জনক-রূপে দক্ষিণ-আফ্রিকায় আবির্ভূত গান্ধিজী সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন, –
“মার খেয়ে পথে মূর্চ্ছা গিয়েছে, পণ যে ছাড়েনি তবু
বারে বারে জরিমানা ক’রে হার মেনে গোরা প্রভু
রদ্ করে বদ্ আইন চরমে রেহাই পেয়েছে তবে”!
জীবনানন্দ দাশ: ‘মহাত্মা গান্ধী’ কবিতায় দুই যুগের ব্যবধানের স্বরূপ অঙ্কন করেন। কবির মনে হয়েছে ভগবান বুদ্ধ ই যেন মানবতার বাণী নিয়ে নবরূপে ভারতবর্ষে এসেছে। তবে অতীতের সেই জ্ঞান, দর্শন, ভালোবাসা ও মূল্যবোধ পাল্টে গেছে আর সে জন্যই ভারতবর্ষ পরাধীন -” তাদের অন্তর্দান সবিশেষ সমুজ্জ্বল ছিল, তবু আজ/ আমাদের পৃথিবী ঢের বহিরাশ্রয়ী”। মানব মৈত্রীর বন্ধন আজ পরাস্ত, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বড় হয়ে উঠেছে। সাম্য -মৈত্রী- স্বাধীনতার কথা বললেই গুলি বর্ষিত হয় -” প্রার্থনা করার মতো বিশ্বাসের গভীরতা কোনো দিকে নেই”।
আজ এই শতাব্দীতে মহাত্মা গান্ধীর সচ্ছলতা
এ-রকম প্রিয় এক প্রতিভাদীপন এনে সকলের প্রাণ
শতকের আঁধারের মাঝখানে কোনো স্থিরতর
নির্দেশের দিকে রেখে গেছে;
রেখে চ’লে গেছে-ব’লে গেছেঃ শান্তি এই, সত্য এই।
শ্রীমতি কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩): বাঙালী মহিলা কবিদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য। তার অন্যতম প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘দীপ ও ধূপ’(১৯২৯। এই কাব্যগ্রন্থটি সম্বন্ধে ডঃ সুকুমার সেন লিখেছেন, “ কয়েকটি কবিতায় গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি কবির সহানুভূতি প্রকটিত। কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেযোগ্য কবিতা ‘সত্যাগ্রাহী’ কবিতাটি ‘বাইকমে সত্যগ্রহ উপলক্ষে’ রচিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কবিতাটি দীর্ঘ, ‘বাহির অঙ্গনে’, ‘মানব অন্তরে’ ও ‘সত্য পূজা’ নামক তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম অংশে দেব-পূজায় সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কবির মতে দেবতা সবার – আর তাই দেব পূজায় সকলেরই অধিকার আছে। এখানে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, ধনী-নির্ধন ভেদাভেদ অর্থহীন।তাই –
“শূদ্র কি ব্রাহ্মণ ধনী কি নির্ধন
সে কি তা বিচার করে?
সর্ব্বান্তকরণেঃ তাহার চরণে
শূদ্র যদি পূজা করে।
বর্ণ তার দেখি ফিরায় তা সে কি
অবহেলে ঘৃণা ভরে”?…
সে যে বিশ্বপিতা সকলের মিতা
এ কথা কি সত্য নয়”?
কবি নরেন্দ্র দেব -এর(১৮৮৮-১৯৭১) একটি কবিতা ‘মহাত্মা’ (প্রথম প্রকাশ: ‘অলকা’, ফাল্গুন, ১৩২৮ সংখ্যা)। কবিতাটিতে গান্ধীজীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গান্ধীবাদের প্রধান প্রধান নীতির আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে গান্ধীজীই ভারতের শ্রেষ্ট মানব এবং গান্ধীবাদই সবচেয়ে উন্নত ও গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক-সামাজিক মতবাদ। কবিতার সূচনাতেই তিনি গান্ধীজীর সত্যবোধ, অহিংসা, দরিদ্র-নারায়ন সেবার উল্লেখ করে গান্ধীজীর উজ্জ্বল মূর্তি অঙ্কন করেছেন, –
“নিন্দা, কলূষ, কল্মষ যারে পারে না করিতে কলঙ্কিত,
হত্যা-বিরোধী সত্যাশ্রয়ী, অত্যাচারেও নহে সে ভীত,
অহিংসা যার পরম মন্ত্র-তন্ত্র যাহার পরম ত্যাগ;
মরম-যন্ত্রে বাজে নিশিদিন দীনের বেদনা দুঃখভাগ”,
শ্রী বিজয় সেনগুপ্ত রচিত ‘মহাপুরুষ’ (প্রথম প্রকাশ: ‘মিলন’ আষাঢ়, ১৩২৯ সংখ্যা) কবিতাটি ‘গান্ধী কীর্তন’ গ্রন্থের অপর একটি কবিতা। গান্ধীজীর আবির্ভাব এদেশে আলোকের সঞ্চার করেছে বলে মনে করেন কবি।এতদিন ভারত ‘ঘোর মোহ-নিদ্রাবশে নিমগ্ন ছিল, গান্ধীজী এসে সেই মোহনিদ্রার অবসান ঘটালেন।নিয়ে এলেন নতুন আলো, নবীন প্রাণ।এই নতুন আলো, ও নবীন প্রাণের স্পর্শে ভারতবাসী সচকিত হয়ে উঠল, তারা গান্ধীজীর পথ অনুসরণ করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলল। তাদের এই পরিবর্তনের কারণ, গান্ধীজীর ভারত আগমন, তাই কবি লিখেছেন, –
“নবীন স্পন্দন প্রাণে জাগে নব আশা
তার মৌন মুখে আজ দিলে তুমি ভাষা।
এত দিনে অবসান হ’ল তার নিশি;
অসাধ্য সাধিলে এ যে সর্ব্বত্যাগী ঋষি!”
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত: নিশান্তিকা কাব্যগ্রন্থের তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হল ‘হে রাম’। কবিতাটির রচনাকাল, চৈত্র, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৪৮।আর গান্ধীজীর মৃত্যু হয় ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮।কথিত আছে যে, মৃত্যুর মুহুর্তে গান্ধীজী ‘হে রাম’ বলে বিড়লা ভবনের মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। সুতরাং বলা যায় যে, যতীন্দ্রনাথ ‘হে রাম’ কবিতাটি গান্ধীজীর মর্ম্মান্তিক মৃত্যুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই রচনা করেছেন।কবি দেখেছেন মহামানবেরা যুগে যুগে মানুষের পাপে প্রাণ বিসর্জন দেন, তবু তারা মানুষকে ক্ষমা করেন। নারায়ণকে হত্যা করে মানুষ এখন ব্যাধে পরিণত হয়েছে। তাই কবি আক্ষেপ করে বলেছেন, –
“কত মুনি ঋষি সন্ন্যাসী ক্রুশী,
কত তপ কত তাপ, –
মানুষের মারে নারায়ণ মরে
খন্ডে না এই পাপ”।
তবু তিনি আততায়ীর বিরুদ্ধে কোনও কথা না বলে ‘হে রাম’ বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।কবি সামান্য কথায় গান্ধী-হত্যার মুহুর্তটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, –
“বাণ বেঁধা বুকে হাসিমাখা মুখে
সে শুধু ‘হে রাম’ বলি,
সাষ্টাঙ্গের প্রণামে প্রণমি
ধূলায় পড়িল ঢলি”।
ডঃ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯): বনফুল নামে বাংলা সাহিত্যের জগতে সবিশেষ পরিচিত। উপন্যাস, ছোটোগল্পে তাঁর সর্বাধিক কৃতিত্ব হলেও কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও তিনি নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন।সমাজ ও তার নানা অসংগতি, রাজনীতি ও তার নানা দুর্নীতি মুখ্য বিষয় হলেও তাঁর কবিতায় নির্মম কশাঘাতের পরিবর্তে প্রচ্ছন্ন এক হাস্যরস সদা প্রবাহমান। এই হাস্যরসের নির্মোক সরিয়ে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকের মতো ব্যাঙ্গের কশাঘাত পাঠককে সচকিত করে সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি সম্বন্ধে সচেতন করে। এইরকমই একটি কবিতা ‘পলিটিক্স আপ-টু ১৯৪০’।সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির বর্ণনায় স্বাভাবিকভাবেই কবিতাটিতে গান্ধীজীর প্রসঙ্গ এসেছে, এসেছে চরকা কাটা ব্রতের কথাও। কবি লিখেছেন, –
“ঘুরালাম চরকা
ঘরকা, পরকা,
পারিলাম যদ্দুর –পরিলাম খদ্দর,
আপামর ভদ্দর।
খদ্দরে, ঘর্মে,
চর্মে চর্মে
চুলকানি ঘামাচিতে হল সবে অস্থির!
উপায় কি স্বস্তির”!
কাজী নজরুল ইসলাম: ভারতের স্বাধীনতা চান, চান ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নয়ন এবং এক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শকে মূল্য দিতে চান না। গান্ধীজী প্রদর্শিত অহিংস পথেই হোক, বা সশস্ত্র বিপ্লববাদের মাধ্যমেই হোক – সাধারণ মানুষের উন্নয়ন হলেই কবির আনন্দ। স্বরাজ সশস্ত্র বিপ্লববাদীরাও নিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু গান্ধীজী ও রবীন্দ্রনাথ কথিত ভারতবাসীর সার্বিক এবং সার্থক উন্নয়নের কর্মসূচীকে উপেক্ষা করলে ভুল হবে বলে মনে করেন কবি। কিন্তু কে শোনে কবির কথা! আক্ষেপ করেন কবি, 
“তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে”!
সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রতি কবি তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেও গান্ধীজীকেই ভারতের প্রকৃত দেশনেতারূপে বরণ করেছেন।গান্ধীজীর বাংলায় আসা উপলক্ষ্যে কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছেন ‘ফণি মনসা’ কাব্যগ্রন্থের (১৯২৭) উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘বাঙলায় মহাত্মা’ জ্যৈষ্ট, ১৩৩১, ১৯২৪। প্রধানত গান্ধীজীর হরিজন আন্দোলনের সমর্থনে রচিত হলেও কবিতাটিতে চরকা প্রথার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গান্ধীজীর আগমন সংবাদ দিয়ে কবি লিখেছেন, –
“ ওই চরকা-চাকায় ঘর্ঘরঘর্
শুনি কাহার আসার খবর,
ঢেউ-দোলাতে দোলে সপ্ত সাগর রে!
ওইপথের ধুলা ডেকেছে আজ সপ্ত কোটি প্রাণ মেলে।
আজজাত-বিজাতের বিভেদ ঘুচি,
এক হল ভাই বামুন-মুচি,
প্রেম-গঙ্গায় সবাই হল শুচি রে!
আয়এই যমুনায় ঝাঁপ দিবি কে বন্দেমাতরম বলে–
ওরে সব মায়ায় আগুন জ্বেলে”।
প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮): -র ‘তিনটি গুলি’ গান্ধীজীর মৃত্যু-বিষয়ক একটি বিখ্যাত জনপ্রিয় কবিতা। ১৯৪৮-এর ৩০শে জানুয়ারি দিল্লীর বিড়লা ভবনে আততায়ী নাথুরাম গডসে গান্ধীজীকে হত্যা করেন। নাথুরাম গান্ধীজীকে লক্ষ্য করে তিনটি গুলি ছুঁড়েছিলেন, একটি গলায়, একটি বুকে অন্যটি তার পেটে আঘাত করে।এর ফলে সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীজীর মৃত্যু হয়। গান্ধীজীর আকষ্মিক হত্যাকান্ডে সমগ্র ভারত উত্তাল হয়ে ওঠে। বাঙালি কবিরাও এই মৃত্যুর দ্বারা প্রবলভাবে প্রবাহিত হলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র তার বেদনা প্রকাশ করলেন ‘তিনটি গুলি’ কবিতার মধ্য দিয়ে। কবি মনে করেন এই ‘তিনটি গুলি’ শুধু গান্ধীজীর জীবন দীপই নিভিয়ে দেয় নি – বিশ্বসংসারকেও স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাই তিনি লিখেছেন, –
“তিনটি গুলির পর
স্তব্ধ এক কন্ঠরুদ্ধ রাত
ভুলে গেল চন্দ্রসূর্য
ভুলে গেল কোথায় প্রভাত”।
গান্ধীজী সারাজীবন ধরে বিশ্বে সত্য-প্রেম-অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য জীবন-পণ করে করেছেন সংগ্রাম। আর অকৃতজ্ঞ মানুষ তাঁকেই কিনা-
“আমরা দিলাম শেষে তুলি
তিনটি কঠিন ক্রুর গুলি”।
বিষ্ণু দে (১৯০৯ – ১৯৮২): বাংলা আধুনিক কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ‘পূর্বলেখ’ (১৯৩৬) কাব্যগ্রন্থের ‘জন্মাষ্টমি’ কবিতাটিতে তথাকথিত গান্ধীবাদী নেতাদের তিনি বিদ্রুপ বাণে বিদ্ধ করেছেন। যে-সময়ে গান্ধীজী ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন সে-সময় ভারতীয় রাজনীতি পরিচালিত হত শহরের উচ্চবৃত্ত শ্রেণীর দ্বারা। এঁদের বেশীর ভাগেরই প্রধান জীবিকা ছিল ব্যবসা। গান্ধীজীও গুজরাটি মোধ-বনিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। ভারতীয় রাজনীতিতে বণিক শ্রেণীর প্রাধান্যকেই কবি কটাক্ষ করেছেন। বিশেষতঃ অনেক ছদ্ম-গান্ধীবাদী নেতাই গান্ধীজীর প্রভাবকে ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সাফল্যের প্রয়াস করেছিলেন। এই রকম কিছু ভন্ড রাজনৈতিক নেতার ‘নির্মোক’ উন্মোচন করেছেন কবি বিষ্ণু দে ‘জন্মাষ্টমি’ কবিতায়, 
“জামাই যে তার নিজে ম্যানেজার
খাদি প্রচারের মস্ত লীডার
দেশের লীডার স্বনামধন্য ত্যাগ স্মরণীয় তার বেয়াই
বণিকের মানদণ্ডই রাজদণ্ড তাই”।
বিমল চন্দ্র ঘোষ (১৯১০-১৯৮২): ‘অখ্যাতজনের নির্বাক মনের কবি’ হিসাবে বাংলা সাহিত্যে সবিশেষ পরিচিত। চল্লিশের দশকে তিনি কম্যুনিষ্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্রথমে দলের পরে ফ্যাসীবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘের সক্রিয় সদস্য-কর্মী হয়ে ওঠেন। কংগ্রেসের প্রতি তাঁর বিরূপতা থাকলেও গান্ধীজীর প্রতি কবির আন্তরিক শ্রদ্ধা ছিল।এ কথা জানা যায় তাঁর ‘নানকিং’(১৯৪৮) কাব্যগ্রন্থের ‘মহাত্মা গান্ধী’ কবিতাটি পাঠ করলে। কবিতাটি গান্ধীজীর অন্যতম প্রিয় শিষ্য সমাজ-সেবক আচার্য্য বিনোবা-ভাবে কে নিবেদন করেছেন।এই কবিতাটি রচিত হয়েছে ’৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮’ অর্থাৎ গান্ধীজীর মৃত্যুদিনে।সুতরাং বলা যায় যে এই কবিতাটিই গান্ধীজীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রচিত সর্বপ্রথম বাংলা কবিতা। কবিতাটিতে কবি গান্ধীজীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা যেমন প্রকাশ করেছেন তেমনি গান্ধীবাদের সত্য-অহিংসা-মানবপ্রেম প্রভৃতি বিষয়গুলিরও উল্লেখ করেছেন এবং এই মহাজীবনে আকষ্মিক প্রয়াণে শোক জ্ঞাপন করেছেন। কবিতায় তিনি গান্ধীজীর অহিংসা নীতি ও দেশবাসীর উন্নয়নের প্রতি গান্ধীজীর আন্তরিকতার উল্লেখ করে লিখেছেন, –
“শত্রুকে কখনো তুমি শত্রু বলে করোনি ঘোষণা
সহৃদয় সমদর্শিতায়!
হিরন্ময় অহিংসামণ্ডিত
আলোকিত মনুষ্যত্বে শুদ্ধ অনুভবে
প্রার্থনা করেছ বারবার:
‘ভগবান! লোকচিত্তে স্বর্গদ্বার খোলো,
হৃদয়ের বিনিময়ে সমদর্শী হোক সর্বজন
বিশাল ভারতে’।
তবু প্রাণ দিতে হল
‘হায় রাম’”।
দিনেশ দাস (১৯১৩-১৯৮৫): ‘কাস্তে কবি’ নামে সমধিক খ্যাত। তিনি ‘এককালের সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী’ ছিলেন। দিনেশ দাসের ‘শ্রেষ্ট কবিতা’ গ্রন্থের ‘কবি-পরিচয়’ অংশে শান্তনু দাস কবির কবিতা রচনার অনুপ্রেরণা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন – “১৯৪৮-এর জাতির জনক- হত্যায় প্রথমে তাঁর (দিনেশ দাস) মর্মবেদনা রূপায়িত হল  ‘শেষ ক্ষমা’ ‘স্বর্ণ ভস্ম’, ‘পুনর্জন্ম’ প্রভৃতি গান্ধী স্মরণীতে”। এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, গান্ধীজীর মহাপ্রয়াণ কবিকে বিচলিত করেছিল। ‘শেষক্ষমা’ (দিনেশ দাসের কবিতা সংকলন, ১৯৫১) কবিতাটি গান্ধীজীর
হত্যা সম্পর্কিত। মহামানবেরা মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন, বিসর্জন দেন প্রাণও। গান্ধী মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে কবি যীশুর উল্লেখ করেছেন। যীশু যেমন মানব কল্যাণের জন্য কাঁটার মুকুট পরে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার সময়েও ‘দুর্জনের তরে তবু চেয়েছ মার্জনা’ – তেমনি গান্ধীজীও মানবকল্যাণেরজন্যই জীবন উৎসর্গকরেছেন এবং, –
“যখন অন্তিম গুলি হৃদপিণ্ডে বিঁধেছে সজোরে
তুমি করজোড়ে
খুনীর নিকট হ’তে পৃথিবীর কাছ হতে অনন্ত নিখিলে
ক্ষমা চেয়ে নিলে:
হেসেছিলে হাসি হিরন্ময়;
যে হাসিতে নিশুতি প্রভাত হয়
কয়লার মত কালো অন্ধকার গ’লে পড়ে হীরক-সকালে”। 
গান্ধীজীই আধুনিক ভারতের প্রকৃত জননেতা। তিনিই প্রথম ভারতের আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতার আন্দোলনে, সামাজিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ডে একসূত্রে বেঁধেছিলেন। বিশেষ কোনও প্রদেশ বা শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর আন্দোলন সীমিত ছিল না – ভারতের সাতলক্ষ গ্রামের মানুষদেরও তিনি আপন করে নিয়েছিলেন।দরিদ্র অসহায় অজ্ঞ ভারতবাসীর তিনি মুক্তিদূত হয়ে উঠেছিলেন। তাই দিনেশ দাস ‘পুনর্জন্ম’ কবিতায় বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, –
“বাংলার মাঠে ঘাটে বাটে
আসাম বিহার গুজরাটে
পেলাম তোমার দেখা
কোটি কোটি লাঙ্গলের ভার নিয়ে হাঁটো একা একা”
কবি দেখেছেন গান্ধীজীর সমকালিন অন্যান্য নেতৃবর্গ যখন ক্ষমতা লাভের আশায় দিল্লীর দিকে চলেছেন, তখন কবি লিখছেন,-
“তুমি বলেছিলে খালি
দিল্লী নয়, চলো নোয়াখালি!”
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩): তিনি রাজনীতি ও কবিতাকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই গান্ধীজীর সব রাজনৈতিক মতাদর্শ কর্মকাণ্ড তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের (১৯৪০) কতগুলি কবিতায় গান্ধী-বিরূপতা প্রকাশিত হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। এই কবিতাগুলির মধ্যে ‘নারদের ডাইরি’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখানে গান্ধীজীর অহিংসানীতি, সত্যাগ্রহ ও কংগ্রেসে গান্ধীজীর একাধিপত্য সম্বন্ধে কবি প্রশ্ন তুলেছেন, –
“বাহান্ন হাতির শুঁড়ে হাঁচিগ্রস্ত অহিংস শকট
বাপুজি, দক্ষিণ করে আনো যুক্তরাষ্ট্রের মিঠাই
সাঙ্গ, প্রভু, সত্যাগ্রহ?একচ্ছত্রে বেজেছে বারোটা?
শেষে কি নৈমিষারণ্যে পাবে আত্মগোপনের ঠাঁই”?
সুকান্ত ভট্টচার্য (১৯২৬-১৯৪৭): বাংলা কাব্যজগতে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই তিনি কবিতা রচনা করতে শুরু করেন।সুকান্তর কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর পূর্বতন কবি সুভাষ মুখোপাধায় লিখেছেন, “সুকান্তর কবিতা কখনই তাঁর জীবন থেকে আলাদা নয়’। সুকান্ত তাঁর নিজস্ব প্রতিবেশ থেকেই কবিতার উপাদান সংগ্রহ করে নিয়েছেন। নিজের কবিতা সম্বন্ধে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘এক সংশয়ের জবাবে সুকান্ত বলেছিল, ‘আমার কবিতা পড়ে পার্টি-কর্মীরা যদি খুশি হয় তা হলেই আমি খুশি’ – । মার্কসবাদে আস্থাবান কবি কবিতার মাধ্যমে মার্কসবাদের প্রচার যেমন করেছেন তেমনি সমকালীন ভারতে গান্ধীজীর প্রবল প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকর করেছেন। তাই ‘মহাত্মাজীর প্রতি’ কবিতায় তিনি গান্ধীজীর অমোঘ আহ্বানের উল্লেখ করেছেন, –
“চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন,
হাঠাৎ ঘোষণা শুনেছি; আমার জীবনে শুভক্ষণ
এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি।
রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী”।
ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থাবান হয়েও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য গান্ধীজীকে ভারতের প্রধানতম নেতারূপেই শুধু নয় – ভারতীয় সভ্যতার একমাত্র রক্ষক রূপেও চিত্রিত করেছেন তাঁর কবিতায়।ভারতে রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য গান্ধীজীর প্রচেষ্টাকে তিনি শুধু দূর থেকে সমর্থনই করেননি – গান্ধীজীর এই কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে চেয়েছেন। কবি গান্ধীজীকে শুধু রাজনৈতিক নেতা-রূপেই নয় ভারতের সামাজিক ক্ষেত্রেও সর্বোত্তম নেতারূপে বরণ করে নিয়েছেন। তাই গান্ধীজীর প্রতি কবির আহ্বান, –
“আজ হাত ধরো গান্ধীজী।
এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার,
এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার”।

আঁকা – অনিন্দিতা সেনগুপ্ত
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।