প্রবন্ধে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

‘মারাদোনা’ – ঈশ্বরের হাত সমৃদ্ধ ফুটবলের রাজপুত্র

‘ঈশ্বরের হাত’ সমৃদ্ধ ফুটবলের রাজপুত্র বা ফুটবলের জাদুকর আর নেই। সৌরভ গাঙ্গুলি টুইট করে লিখলেন, My hero no more..my mad genius rest in peace ..I watched football for you.. (‘আমার হিরো আর নেই। আমার পাগল জিনিয়াস, প্রতিভাধর শান্তিতে থাকো। তোমার জন্যই ফুটবল দেখতাম আমি’)। আর্জেন্টিনার ভাষায় ‘ফুটবলের ঈশ্বর’ ডিয়েগো ম্যারাডোনা পুরো ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। প্রসঙ্গত, খেলা ছাড়ার পর দুবার কলকাতা এসেছিলেন ফুটবলের রাজপুত্র। তাঁকে ঘিরে অভাবনীয় উচ্ছ্বাস, অভূতপূর্ব আবেগে ভেসে গিয়েছিল কল্লোলিনী কলকাতা। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ৬০ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা তিগ্রে-তে মারা যান (৩০ অক্টোবর ১৯৬০ – ২৫ নভেম্বর ২০২০)।
সময়টা ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ। বিপক্ষ ইংল্যান্ড। সেদিন খেলতে নামার আগে সব আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের মনে ছিল তীব্র জিগীষা; আর গ্যালারির লাখো সমর্থকদের সাথে সকল আর্জেন্টাইনদের মুখে ছিল প্রতিশোধের বুলি। কোন ম্যাচের কথা বলা হচ্ছে তা বুঝতে কি আর ফুটবল অনুরাগী হবার দরকার আছে? এ লড়াই তো ফুটবল মাঠের লড়াই নয় কেবল, এ লড়াই রক্ত ঝরা হৃদয়ের ক্ষত বন্ধ করার লড়াই, এ লড়াই হাজার স্বজন-হারা আর্জেন্টাইনদের চোখের জল মুছে দেবার লড়াই। সেদিন তার পায়ের জাদু দিয়ে কিভাবে আঘাত করেছিলেন ইংলিশদের বিশ্বকাপ স্বপ্নে। সেই হাত দিয়ে করা গোলের কথা, যার মিনিট পাঁচেক পরেই করেছিলেন গত শতাব্দীর অন্যতম সেরা গোল; যাকে শতাব্দীর সেরা গোল বলতেও অনেকে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না।
শুধু ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ ছাড়াও, ম্যাচে আগুন জ্বালানোর জন্য পর্যাপ্ত ফুটবলীয় বারুদও তো কম মজুদ ছিল না। ৮৬ বিশ্বকাপের ঐ ম্যাচের আগে দুই দলের শেষ বিশ্বকাপ দ্বৈরথ ৬৬ এর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। জিওফ হার্স্ট এর একমাত্র গোলে ইংল্যান্ড সেই ম্যাচে হারায় ১০ জনের আর্জেন্টিনা কে। আর্জেন্টাইন ক্যাপ্টেন অ্যান্টনিও রাটিন সেই ম্যাচে দেখেন লাল কার্ড, ম্যাচ শেষে যাকে পুলিশ পাহারায় হোটেলে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। আর্জেন্টাইনরা কখনই এ লাল কার্ড কে মেনে নিতে পারেনি। হার্স্ট এর গোলটাও বিশুদ্ধ অফ-সাইড ছিল বলে দাবি করে। তারা ঐ গেমটার একটা নামও দিয়ে দেয়; এল রবো দেল সিগলো মানে কিনা শতাব্দীর সেরা চুরি। আর ৮৬ এর ম্যাচের আগে শেষ দেখা ৮০ সালে, ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ড ৩-১ গোলের লজ্জায় ডুবায় আর্জেন্টিনা কে। প্রতিশোধের ব্যাপার তাই এমনিতেই ছিল, সাথে ছিল ৮২ তে শুরু হওয়া ফকল্যান্ড যুদ্ধের ক্ষত।
প্রথম হাফে কোনও গোল হয়নি। ম্যারাডোনা বেশ কয়বার বল নিয়ে ছন্দ দেখালেও গোলমুখ খুলতে পারছিলেন না। অসাধারণ উত্তেজনার ম্যাচের সাধারণ প্রথমার্ধ। তবে কে ভেবেছিল, এই সাধারণত্বকে পুষিয়ে দিয়ে ম্যাচটি পরে ঢুকে যাবে ইতিহাসের পাতায়!
দ্বিতীয়ার্ধের ৫১তম মিনিট-এর মাথায় বল নিয়ে এগিয়ে গেলেন ম্যারাডোনা। বক্সের বাইরে দাঁড়ানো ভালদানো কে পাস দিয়ে গুলির বেগে ডিফেন্ডারদের ভেদ করে ঢুকে গেলেন বক্সে। ভালদানোর বাড়ানো বল ডিফেন্সে বাঁধা পেয়ে উঠে গেল আকাশে, আর ম্যারাডোনা হেড করলেন ‘হাত’ দিয়ে। বল জালে জড়াতেই ম্যারাডোনা দৌড়ে গেলেন দর্শক সারির দিকে। ইংলিশদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কোনও লাভ হল না । রেফারি বাজিয়ে দিলেন গোলের বাঁশি।
গোলটা যে মাথার নয় হাতের ছিল সেটা পরে হাত দিয়ে গ্যালারির উদ্দেশ্যে বুঝিয়ে দিলেন ম্যারাডোনা স্বয়ং! কলঙ্কিত গোল বলেই কিনা, কলঙ্কটা মুছতে তিনি সময় নিলেন মাত্র ৫ মিনিট। ঐ গোলের মহিমা বর্ণনা করতে শত শত পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে, অনেক কালি খরচ হয়েছে। কিন্তু তবু তার সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করা যায়নি। তখন হয়তো অন্য কোন গ্রহ হতে অন্য কিছু শক্তি ভর করেছিল আর্জেন্টাইনদের ফুটবল ঈশ্বরের উপর। নইলে মাত্র ৪ মিনিটের মধ্যে মাঝমাঠ থেকে কিভাবে ৭ জনকে কাটিয়ে একজন মানুষ দ্বিতীয় গোল পারেন? যেটিকে ফিফা পরবর্তীতে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করে। মাঠে নিজেদের অর্ধে তিনি বল গ্রহণ করেন, ইংল্যান্ডের গোলপোস্টের দিকে ঘুরে দাড়ান এবং মাঠের অর্ধেকেরও বেশি অংশ দৌড়িয়ে, পাঁচ জন ইংরেজ ডিফেন্ডার (পিটার বেয়ার্ডসলি, স্টিভ হজ, পিটার রেইড, টেরি বাচার ও টেরি ফেনউইক) এবং গোলরক্ষক পিটার শিলটন কাটিয়ে গোল করেন। ২০০২ সালে, ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে এই গোলটি “শতাব্দীর সেরা গোল” হিসেবে নির্বাচিত হয়। গোলটা এত দ্রুত হয়ে গিয়েছিল যে, আর্জেন্টাইন প্লেয়াররাও বুঝতে পারেন নি ওটা গোল! হতভম্ব ইংলিশরা এরপর আর খেলাতেই ফিরতে পারেনি। ৮১ মিনিটে গ্যারি লিনেকার হেডে একটি গোল ফিরিয়ে দিলেও কখনোই মনে হয়নি ইংলিশরা এই ম্যাচ জিততে পারবে। লাতিন ছন্দের কাছে ইউরোপিয়ান পাওয়ার ছিল একেবারেই অসহায়। ম্যাচটির মাহাত্ম্য এতোটাই বেশি যে, তার রেশ এই ৩৩ বছর পরে এসেও ফুরোয়নি। ইংলিশদের কাছে ঐ ম্যাচ আর্জেন্টাইনদের চুরি করে পাওয়া জয়, আর আর্জেন্টাইনদের কাছে তা ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ। হাত দিয়ে গোল করাটাকেই তারা মনে করে বেশি ভাল হয়েছে, কারণ এটি ইংলিশদের আরও বেশি পুড়িয়েছে, আরও বেশি জ্বালা ধরিয়েছে। ঐ ম্যাচের পর ম্যারাডোনার হাতের নামই তাই হয়ে গেল “দ্য হ্যান্ড অফ গড”।
বিশেষজ্ঞ, ফুটবল সমালোচক, প্রাক্তন ও বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থকরা তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে গন্য করেন। তিনি ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ে পেলের সাথে যৌথভাবে ছিলেন। নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারে মারাদোনা আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন। ক্লাব পর্যায়ে তিনি তার নাপোলিতে কাটানো সময়ের জন্য বিখ্যাত, যেখানে তিনি অসংখ্য সম্মাননা জিতেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি ৯১ খেলায় ৩৪ গোল করেন।
তিনি চারটি ফিফা বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। যার মধ্যে ছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপ, যেখানে তিনি আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং দলকে বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দেন। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বর্ণগোলক জিতেন তিনি। প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনার পক্ষে উভয় গোলই করেন মারাদোনা। দুইটি গোলই ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দুইটি ভিন্ন কারণে। প্রথম গোলটি ছিল হ্যান্ডবল যা “হ্যান্ড অফ গড” নামে খ্যাত। দ্বিতীয় গোলটি মারাদোনা প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে করেন। ২০০২ সালে ফিফাডটকম এর ভোটাররা গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসাবে নির্বাচিত করে।
দিয়েগো মারাদোনা ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েনোস আইরেস প্রদেশের লানুস শহরের পলিক্লিনিকো এভিতা হাসপাতালে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তবে তিনি বেড়ে ওঠেন ভিয়া ফিওরিতোতে যা বুয়েনোস আইরেসের দক্ষিণ প্রান্তের একটি শান্তিটাউন। তিন কন্যা সন্তানের পর তিনিই ছিলেন বাবা-মা’র প্রথম পুত্র সন্তান। তার ছোট দুই ভাই ররেছে হুগো [এল তুর্কো] এবং রাউল (লালো), যাদের উভয়েই পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়।
মারাদোনা হলেন ‘চিতরো’ দিয়েগো মারাদোনা এবং ‘দোনা তোতা’ দালমা সালভাদর ফ্রাঙ্কোর পঞ্চম সন্তান। ১০ বছর বয়সে, যখন তিনি এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলছিলেন তখন তাকে খুঁজে বের করেন একজন স্কাউট। তিনি দ্য লিটল অনিঅনের (আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দল) একজন মূল খেলোয়াড়ে পরিণত হন। ১২ বছর বয়সে বল-বয় হিসেবে, প্রথম বিভাগের খেলার অর্ধ বিরতির সময় বল দিয়ে জাদুকরি কারুকার্য দেখিয়ে তিনি দর্শকদের সন্তুষ্ট করতেন।
আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স এবং বোকা জুনিয়র্স
১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর, নিজের ষোলতম জন্মদিনের দশ দিন আগে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে মারাদোনার অভিষেক হয়। সেখানে তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন এবং ১৬৭ খেলায় ১১৫টি গোল করেন। এরপর তিনি ১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বোকা জুনিয়র্সে, পাড়ি জমান। ১৯৮১ মৌসুমের মাঝামাঝি সময় বোকায় যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন।
বার্সেলোনা
১৯৮২ বিশ্বকাপের পর ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন মারাদোনা। ১৯৮৩ সালে, কোচ সিজার লুইস মেনত্তির অধীনে বার্সেলোনা এবং মারাদোনা রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে এবং অ্যাথলেটিক বিলবাওকে হারিয়ে স্পেনীয় সুপর কাপ জিতে। বার্সেলোনায় মারাদোনা ৫৮ খেলায় ৩৮টি গোল করেন।
নাপোলি
১৯৮৫ সালে নাপোলির হয়ে খেলছেন মারাদোনা। নাপোলিতে মারাদোনা তার পেশাদার ক্যারিয়ারের শিখরে পৌছান। তিনি খুব দ্রুত ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সেই সময়টিই ছিল নাপোলির ইতিহাসের সফলতম যুগ। মারাদোনার অধীনে নাপোলি ১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এবং ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানার-আপ হয়। এছাড়া মারাদোনার সময়ে নাপোলি একবার কোপা ইতালিয়া জিতে (১৯৮৭) এবং একবার রানার-আপ (১৯৮৯) হয় এবং ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ জিতে। ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরি এ-তে মারাদোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।
সেভিয়া, নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ এবং বোকা জুনিয়র্স
ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ১৯৯২ সালে মারাদোনা নাপোলি ছেড়ে দেন। স্পেনীয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং ফরাসি ক্লাব অলিম্পিকে মার্শেই তার প্রতি আগ্রহী হলেও তিনি স্পেনীয় ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি লিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেন এবং ১৯৯৫ সালে তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন এবং সেখানে দুই বছর খেলেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কিছু পূর্বে মারাদোনা টটেনহাম হটস্পারের হয়েও মাঠে নামেন ইন্টারন্যাজিওনালের বিপক্ষে। খেলায় টটেনহাম ২–১ গোলে জয় লাভ করে। তিনি গ্লেন হোডেলের সাথে খেলেন, যিনি মারাদোনার জন্য তার ১০ নম্বর জার্সিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার
আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে মারাদোনা টানা চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ১৯৮৬ -তে আর্জেন্টিনা বিজয়ী হয় এবং ১৯৯০-এ হয় রানার-আপ। ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে মারাদোনার অভিষেক হয়। ১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ফিফা বিশ্ব যুব চাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতার ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩–১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। ১৯৭৯ সালের ২ জুন, স্কটল্যাণ্ডের বিপক্ষে সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম গোল করেন মারাদোনা। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ফিফা অনূর্ধ ২০ বিশবকাপ (১৯৭৯) ও ফিফা বিশ্বকাপ (১৯৮৬) উভয় প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন বল জিতেছেন।
১৯৮২ বিশ্বকাপ
মারাদোনার ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা ছিল ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী খেলায় ক্যাম্প ন্যু-তে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় বেলজিয়ামের। কাতালান দর্শকরা তাদের ক্লাব বার্সেলোনায় নতুন যোগ দেওয়া মারাদোনার চমক দেখার জন্য আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তিনি আশানুরূপ নৈপুণ্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হন। আর্জেন্টিনা বেলজিয়ামের বিপক্ষে ১–০ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়। গ্রুপ পর্বের অপর দুই খেলায় হাঙ্গেরি এবং এল স্যালভাদরের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা জয় লাভ করে এবং দ্বিতীয় পর্বে পৌঁছায়। কিন্তু, দ্বিতীয় পর্বে ইতালি এবং ব্রাজলের বিপক্ষে পরাজিত হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার সবকয়টি খেলায় পুরো সময় মাঠে ছিলেন মারাদোনা। হাঙ্গেরির বিপক্ষে তিনি দুইটি গোল করেন, তবে ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলা শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে ফাউল করার দায়ে তাকে লাল কার্ড দেখানো হয়।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ
১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মারাদোনা। প্রতিযোগিতার ফাইনালে পশ্চিম জার্মানীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। প্রতিযোগিতার পুরোটা জুড়েই ছিল মারাদোনার আধিপত্য। তিনি আর্জেন্টিনার প্রত্যেকটি খেলায় পুরোটা সময়ই মাঠে ছিলেন। পুরো প্রতিযোগিতায় তিনি পাঁচটি গোল করেন এবং সতীর্থদের দিয়ে করান আরও পাঁচটি। প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম গোল করেন ইতালির বিপক্ষে, গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় খেলায়। কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যাণ্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল করে নিজেকে কিংবদন্তি হিসেবে প্রমাণ করেন তিনি। সেমি-ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও তিনি জোড়া গোল করেন। ফাইনালে, প্রতিপক্ষ পশ্চিম জার্মানী তাকে ডাবল-মার্কিং করে রাখে। তা সত্ত্বেও, তারই বাড়িয়ে দেওয়া পাসে আর্জেন্টিনার পক্ষে জয়সূচক গোল করেন হোর্হ বুরুচাগা । ইস্তাদিও অ্যাজতেকার ১১৫,০০০ দর্শকের সামনে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩–২ গোলের ব্যবধানে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা।
প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার ১৪টি গোলের ১০টিতেই মারাদোনার অবদান ছিল, গোলপোস্টে আর্জেন্টিনার পুরো দলের নেয়া মোট শটের অর্ধেকেরও বেশি ছিল তার তৈরি করা। পুরো প্রতিযোগিতা জুড়ে ছিল তার দাপট। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের আতঙ্কের কারণ ছিলেন তিনি। প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে ফুটবল কিংবদন্তিদের খাতায় নিজের নাম লিখিয়ে নেন মারাদোনা। প্রতিযোগিতা শেষে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মারাদোনাকে গোল্ডেন বল পুরস্কার দেওয়া হয়। তাকে একক প্রচেষ্টায় বিশ্বকাপ জয়ী হিসেবে ব্যাপকভাবে গণ্য করা হয়। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে স্তাদিও অ্যাজতেকা কর্তৃপক্ষ স্টেডিয়ামটির সামনে মারাদোনার গোল অফ দ্য সেঞ্চুরির একটি প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেছে। প্রতিমূর্তিটি স্টেডিয়ামের প্রবেশপথের সামনে স্থাপিত।
১৯৯০ বিশ্বকাপ
১৯৯০ বিশ্বকাপে পুনরায় আর্জেন্টিনার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন মারাদোনা। কিন্তু, গোড়ালির ইনজুরির কারণে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মত নৈপূন্য তিনি দেখাতে পারেননি। প্রথম পর্বে গ্রুপে তৃতীয় স্থানে থেকেও কোনরকমে দ্বিতীয় পর্বের টিকিট পায় আর্জেন্টিনা। ১৬ দলের পর্বে ব্রাজিলের বিপক্ষে ক্লদিও ক্যানিজিয়ার একমাত্র গোলে জয় পায় তারা, গোলটি মারাদোনারই বানিয়ে দেওয়া ছিল। কোয়ার্টার-ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় ইয়োগোস্লাভিয়ার খেলাটি ১২০ মিনিট পর্যন্ত ০–০ সমতায় শেষ হলে পেনাল্টি পর্যন্ত গড়ায়। গোলরক্ষকের ডান পাশে নেওয়া মারাদোনার দূর্বল শটটি গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দেন। তবুও আর্জেন্টিনা ৩–২ ব্যবধানে পেনাল্টিতে জয় লাভ করে। সেমি-ফাইনালে, ইতালির বিপক্ষে ১২০ মিনিট পর্যন্ত স্কোর ছিল ১–১, ফলে এবারও খেলা গড়ায় পেনাল্টিতে। এবারও মারাদোনা একই ধরনের শট নেন। তবে এবার বলটি ঠিকটি গোলপোস্টের জালে জড়ায়। ফাইনালে এবারও আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় পশ্চিম জার্মানির। খেলায় রুডি ফোলারকে ফাউল করার কারণে দেওয়া বিতর্কিত পেনাল্টিতে আনড্রেয়াস ব্রেহমার করা একমাত্র গোলে জয় পায় পশ্চিম জার্মানি।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ
১৯৯৪ বিশ্বকাপে মারাদোনা শুধুমাত্র দুটি খেলায় মাঠে নামেন। এর মধ্যে গ্রীসের বিপক্ষে তিনি একটি গোল করেন। ড্রাগ টেস্টে এফিড্রিন ডোপিং-এর কারণে তাকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়। নিজের আত্মজীবনীতে মারাদোনা ঐ টেস্ট সম্পর্কে বলেন যে তার ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক তাকে এনার্জি ড্রিংক রিপ ফুয়েল দেওয়ার কারণে তিনি ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়েছেন। তার দাবি ছিল, পানীয়টির যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্করণ আর্জেন্টিনীয় সংস্করণের মত নয়, যার মধ্যে ঐ রাসায়নিক দ্রব্যটি ছিল এবং তার প্রশিক্ষক অনিচ্ছাকৃতভাবে তা ব্যবহার করে। ফিফা তাকে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করে এবং আর্জেন্টিনাও দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। মারাদোনা আলাদাভাবে এও দাবী করেন যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পূর্বে ওজন কমানোর জন্য ঐ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে ফিফার সাথে তার একটি চুক্তি হয়েছিল।
১৯৯৪ বিশ্বকাপের পর মারাদোনার ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। পুরো ক্যারিয়ারে তিনি ৯১ খেলায় ৩৪টি গোল করেন।
সম্মাননা
এফসি বার্সেলোনা জাদুঘরে রাখা মারাদোনার শার্ট। ২০০০ সালে, ফিফা মারাদোনাকে শতাব্দীরসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করে। যা নির্বাচিত হয় তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ও অফিসিয়াল ম্যাগাজিনে ভোট এবং বিচারকের মাধ্যমে। অনলাইন ভোটে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয় মারাদোনা। তিনি পান ৫৩.৬% ভোট, যেখানে পেলে পেয়েছিলেন ১৮.৫৩% ভোট। ২০০১ সালে, আর্জৃন্টিনীয় ফুটবল অ্যসোসিয়েশন ফিফা কর্তৃপক্ষের কাছে ১০ নম্বর জার্সিটি বন্ধ করে দেওয়ার আবেদন জানায়। অবশ্য, ফিফা এই আবেদন গ্রহণ করেনি, তবুও আর্জেন্টিনীয় কর্মকর্তারা নিশ্চয়তা দেন যে ফিফা তাদেরকে এমনটি করার সংকেত দিয়েছে। ২০০২ সালে সমর্থকদের ভোটে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মারাদোনার করা দ্বিতীয় গোলটি ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা গোল নির্বাচিত হয়।
কোচিং ক্যারিয়ার
২০০৯ সালে আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে মারাদোনা। ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ আল্ফিও পদত্যাগ করলে এই গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তাত্‍ক্ষণিকভাবে মারাদোনা নিজের প্রার্থীতা ঘোষণা করেন। কিছু সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এই পদের জন্য তার প্রধান প্রতিদ্বন্দি ছিলেন দিয়েগো সাইমন, কার্লোস বিয়াঞ্চি, মুগুয়েল অ্যাঞ্জেল রুসো এবং সার্হিও বাতিস্তা। ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর, এএফএ চেয়ারম্যান হুলিও গ্রন্দোনা নিশ্চিত করেন যে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে মারাদোনা জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করবেন। ২০০৮ সালের ১৯ নভেম্বর, স্কটল্যাণ্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার খেলায় মারাদোনা প্রথমবারের মত দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। খেলায় আর্জেন্টিনা ১–০ গোলের ব্যবধানে জয় লাভ করে। মৃত্যুর সময়ও তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ক্লাব জিমনাসিয়া ডি লা প্লাটার কোচ। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ফুটবল বিশ্ব। একের এক আসছে শোকবার্তা। কিংবদন্তি ফুটবলারকে শ্রদ্ধা জানানোর পালা চলছে। অনেকের মতে, তিনিই বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার। [তথ্যসূত্র: ইন্টানেট / উইকিপিডিয়া]
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।