গল্প নাট্যে ঈশানী রায়চৌধুরী

জল

‘শুনেন শুনেন ভদ্দরজন ই ঠিনে আজ রাম সীতার পালা হবেক…. লে ভজইন্যা কাঁসি পিট্যা…. টুকদু হাঁকাই দে ক্যানে। সি.. তা.. হ.. র.ন পালা… সকলে আইসবেন আইজ্ঞা! ভজইন্যা বাজা দমে কাঁসি বাজা । ‘–পালার ঢ্যারা শুনে তীরবেগে ঝুপড়ির দিকে ছুটতে থাকে মেয়ে…. মা, মারে পালা লেগ্যেছে…পালা লেগ্যেছে । আবার ঢোল কাঁসি বাজে –
‘ দিনমানে পালা হব্যেক নাই, সাঁঝ তক্ক হ্যাচাক বাতি লিয়ে হব্যেক ‘
হাঁফাতে হাঁফাতে ঝুপড়িতে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে সে… চমকে উঠে বলে, মা তুর গা তো আগগুন পারা.. চোখট’ লাল হইঙছে। আইজ তুর জল আনার কাম নাই মাথ্যাট ঘুরাই পড়বিক বুটে । মুকে কলসিখান দে — দু ক্কশ দূরের কুয়া থিক্কা জল আইনবক । মা জ্বরের ঘোরে ঘোলাটে চোখে চেয়ে থাকে মেয়ের দিকে, গলা শুকিয়ে কাঠ…. চেষ্টা করেও কোন আওয়াজ বেরোয় না । মেয়ে আবার ডাকে ‘ ও মা, তু রা কাড়িস নাই ক্যানে? ই ঠিনের নুনা নুনিরাও যায় বটেক ‘….. মা তার দুর্বল হাতটা দিয়ে ধরে রাখতে চায় মেয়ের হাত । চোখের জল গড়িয়ে পড়ে খড়ের বিছানায় । উঠে বসার প্রানপন চেষ্টায় তার কপালের শিরা ফুলে ওঠে । মেয়ে তাড়াতাড়ি মাকে আবার শুইয়ে দেয়…. নরম গলায় বলে ‘ মারে ডর কিসসের তুর? গেরামের সাউলি মুঙলি তো যায়! টুকচেক নুনপান্তা খাইয়ে লিব । তু আরাম কর ‘।
মেয়ের আর তর সয় না ।সাঁঝে পালা শুনতে হবে না! ঝুপড়ি থেকে কলসিখানা নিয়ে ছুটে বেরোয় । গলা চিরে মা ডাকে, ‘ নুন্নি, নুন্নি.. হেই মারাংবুরু উয়ারে দেইখ্য
বড় খুশি আজ মেয়ের — বুনো হরিণীর মত কলসি নিয়ে দৌড়োয় আর গান গায়
“রাত ফুরালে রাণীগঞ্জ যাইতে হবেক সই
সঙ্গে লিব মিহিজামের গুড় চিড়া দই ।
জাম তাড়ার হাটে লিব লাল শাড়ি কিনে
রাঙা হব্যেক বৌয়ের গাল লাল চুড়ি পিনে ।
কালো বউয়ের কালো চখে চান্দের রোশনাই
কয়লা খাদের গহীন গাড়ায় ফিরতে মন নাই । “
চোত মাসের খরায় ফাটা মাঠ পেরিয়ে… ধু ধু বনের শুকনো পাতা মাড়িয়ে ছুটতে থাকে মেয়ে । ‘ হেই মারাংবুরু আর কত্ত দূর! আংরা পুড়া আক্কাশ য্যান আগগুন উগলাইছে। সূয্যিঠাকুর আগুন ধুইনতে বইসছে বটেক । মহাজনের কুয়ায় তার নুনা নুনি চান করে, কুত্তায় জল চেটে খায় কিন্তুক সি জলে আমরা মুখ দিতে লারব । ই ক্যামুন দ্যাশ মা! তু টুকচা আরাম কর!’

মাথার কলসি থেকে জল পড়ে ভিজে যায় মেয়ের কাপড় । তবু সে ছুটতে থাকে, ভয় পায়.. হুড়ালের ভয়! হঠাৎ একটা ছায়া দেখে চমকে ওঠে সে….’ক্কে, কে বটেক?…. মোড়লের পো তু… তু মুর পথ কাটচিস কেনে ? মুর মা জ্বরে বেহোঁশ… উর গলায় টুকচা জল দিতে হবেক ‘ ।
ঘড়ঘড়ে গলায় উত্তর এল ‘জল কেনে রে, বিলাইতি আছে… বিলাইতি দে! তুরে তো বলচি মুর সাতে বোম্বাই চল, তুরে মু রানি কইরে রাইখবক ।’…. ‘পথ কাটিস নাই, মুকে ঘর যাত্যে হবেক.. মা বিষহরির কিরে, মুর মাত্থায় আগগুনটো জ্বলে বটেক ‘! মেয়ে মাথার কলসি দুইহাতে আঁকড়িয়ে ধরে । নোংরা বীভৎস হাসি হেসে মোড়লের ছেলে বলে — ‘তু কলসিখান ধইরা রাখ.. আমি তর কলসিখান ধরি । ভিজা কাপড় খুইল্লা দে.. তর জ্বর হইব ‘— হলুদ দাঁতে খটাসের হাসি হাসে ।
……. এদিকে ঘরে মা জ্বরের ঘোরে ভুল বকে… ঝুপড়ির বেড়ায় মাথা ঠোকে আর কাঁদে…..’ ফিরে আয় নুন্নি.. মর বুকে আয়…. মু জল খাবক নাইরে….. নু..ন্নি!’
— বাতাসে মায়ের গোঙ্গানি বুঝি মেয়ের বুকেও ছড়িয়ে পড়ে..সে ছটফট করে ওঠে। পেটের আগুন আর আকাশের আগুন তাকে পাগল করে তোলে । তেষ্টায় ছাতি ফাটে… লাল চোখে সে চারদিকে তাকায় আর বাঁচার রাস্তা খোঁজে ।
….. সুযোগ বুঝে তার স্তন খামচে ধরে মাতালটা! চোখের নিমেষে চৌচির হয়ে যায় কলসীটা আর উন্মাদ মেয়ে তুলে আনে বড় পাথর। মাথার ভেতর ফোয়ারার মত রক্ত ছোটে । সে প্রানপনে পাথর দিয়ে মাথায় ঘা মারে মাতালটার….. রক্তে ভেসে যায় তার শরীর । টলতে টলতে দৌড়োয় ঘরের দিকে…. ‘মা, মারে আমি জল আনতে লারছি মা ‘
নিথর মায়ের শুকনো পাঁজরে লুটিয়ে পড়ে মেয়ে ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।