রম্য রচনায় ইন্দ্রানী ঘোষ

অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে 
সিরিজ (২)

ওলিয়েন্ডর দিদিমণির নয় নয় করে বেশ কয়েক বছর চাকরী হয়ে গেছে দার্জিলিং এ । বাড়ী থেকে সংসারী হবার জন্য ক্রমাগত চাপ আসছে । এ হেন সময়ে দিদিমণির দেখা হয়ে গেল দার্জিলিং এ এক অধ্যাপকের সঙ্গে । তিনি দর্শনের অধ্যাপক, বিয়ে করেন নি, অতি জাগতিক এবং জাগতিকের মেল বন্ধনে তাঁর বিশেষ আগ্রহ । অধ্যাপকের নাম পলাশ বসু । লাইব্ররীতে বেশ কয়েকবার ওলিয়েন্ডরের সাথে তাঁর দেখা । দুজনে দু একটা সেমিনার, বক্তৃতা একসঙ্গে হাজির হলেন । প্রেম জমতে সময় লাগল না । ওলিয়েন্ডর দিদিমণি বেজায় খুশি, যাক বাবা দার্জিলিং ছেড়ে যেতে হবে না । চাকরী জীবন দুজনেই এখানেই কাটিয়ে, অবসর কালে পাহাড় থেকে নেমে যাবেন কি না ভাববেন । দু বাড়ীর মত নিয়ে পরের গরমের ছুটিতে তাঁরা বিয়ে সেরে ফেললেন ।
ওলিয়েন্ডর দিদিমণির এবং তাঁর স্বামী অধ্যাপক পলাশ বাবুর সবচেয়ে বড় মিল হল দুজনেই অচেনা অজানাদের শ্রদ্ধা করেন । অযথা কৌতুহল দেখিয়ে তাদের বিরক্ত করেন না । তা যে ঘটনার কথা বলতে চলেছি তা পলাশ বাবুর অভিজ্ঞতা, আমি দিদিমণির কাছে শুনেছি ।
সেই সময়কার দার্জিলিং শহরে মানে আশির দশকে রাত নামত খুব তাড়াতাড়ি । খাদের দিক থেকে কুয়াশা এসে লেপেপুছে দিত শহরের অলি, গলি, গির্জা, ইস্কুল, কলেজ । দূর পাহাড়ে টিমটিম করে আলো জ্বলত। যেদিন কুয়াশার ছুটি, সেদিন চাঁদ বেড়িয়ে এসে ধুয়ে দিচ্ছে শহরের আনাচ কানাচ । পলাশ বাবু লাইব্রেরী থেকে ফিরছেন । রাত বাড়ছে ঠান্ডাও বাড়ছে । এমন সময় পলাশ বাবুর সামনে প্রায় মাটি ফুড়ে এসে দাঁড়াল এক দৈত্যের মত বিশাল লালমুখো সাহেব । তাঁর উচ্চতা ছয় ফুটের উপর । ওভারকোট, গাম্বুটে আপাদমস্তক ঢাকা । চোখদুটি বুদ্ধিতে জ্বলজ্বল করছে, অসম্ভব তীক্ষ সেই দৃষ্টি । চাঁদের আলো পিছলে পড়ছে মুখ মন্ডলে, মুখে পাইপ ধরা। সাহেব জিজ্ঞেস করলেন ‘ডু ইউ হ্যাভ আ ম্যাচবক্স?’ পলাশ বাবু দেশলাই বার করে দিলেন । মনে মনে ভাবলেন বাকি রাস্তাটুকু সাহেবের সাথে গপ্প করতে করতে চলে যাবেন । পলাশ বাবু জিজ্ঞেস করলেন ‘উইল ইউ বি গোয়িং টুওয়ার্ডস দ্য চার্চ?’, সাহেব একগাল হেসে বললে ‘ইয়েস, উড লাভ টু ওয়াক উইথ ইউ’ । নেশাড়ুরা আবার নেশার বস্তুটি হাতে থাকলে গপ্পে মজে যায় তাড়াতাড়ি । পলাশ বাবুও সিগারেট ধরালেন । দুজনেই ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে এগোলেন ।
পলাশ বাবু জিজ্ঞেস করলেন ‘ আর ইউ আ টুরিষ্ট?’
সাহেব বললেন ‘নো, আই লিভ হিয়ার, আই লিভ উইথ দিস ইউক্যালিপ্টস ট্রীস, উইথ দ্য এডিফিস অফ দ্য চার্চ, উইথ দ্য কল অফ দ্য মিনিভেটস সানবার্ডস এন্ড বারবেটস ।’
পলাশ বাবু বলতে যাবেন সাহেবকে একটু খুলে ব্যাপারটা বলতে, এমন সময় কোথা থেকে একরাশ কুয়াশা এসে সাহেবকে ঢেকে দিল । যেমন সাহেব এসেছিলেন মাটি ফুড়ে, তেমন চলেও গেলেন । বাড়ী এসে ওলিয়েন্ডর দিদিমণির সাথে ডিনার খেতে বসে দুজনে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে গেলে বুঝলেন যে সাহেব মানুষের প্রকৃতিতে বিলীন হওয়ার কথাই বলেছেন । দুজনেই মনে মনে ভাবলেন আহা সাহেব আরেকবার দেখা দিলে একটু মন খুলে গল্প করা যাবে। সাহেব বেশ রসিক । তবে তাঁকে ভয় পেলে চলবে না ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।