সাপ্তাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (পর্ব – ২৪)

অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে (পর্ব – ৩)

অচেনা কুয়াশাময় ।
কুয়াশা কে মুঠি করে ধরা যায় না । যেভাবে সে থাকে থাকুক । ভয় না পেলেই হল । আমাদের মামাবাড়ীতে সবাই তাই বলেন ।
আমার বড় মামার নিত্য ওঠাবসা ছিল এমন বন্ধুবান্ধুবদের সাথে যারা পুনা ইউনিভার্সিটি, ফার্গুসন কলেজ এবং পুনে ফিল্ম এন্ড টেলেভিসিন ইন্সটিটিউট শাসন করেছেন এবং পরবর্তীকালে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীতে নিজেদের জায়গা বেশ পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন । এদের মধ্যে মহেশ আনে, কিরণ দিওয়ান, পঙ্কজ পরাসর, জারিনা ওয়াহাব, মিঠুন চক্রবর্তী, তব্বসসুম এরা সকলেই বেশ চেনা নাম । বিশেষ করে তাদের কাছে চেনা , যারা সেই সময়কার মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের খোজখবর রাখতেন বা এখনো রাখেন । এই সব তারকারা তাদের বিভিন্ন কাজে এই পুনা শহরের এই তিন ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ‘অচেনা’ ঘটনার কথা বলেছেন । কোন সৃষ্টিকর্মে কোন ঘটনার কথা ছিল আমার স্মৃতিতে নেই । তবে কয়েকটি বিশেষ ঘটনা সেই সময়তে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং তার চর্চা আজও অব্যাহত । সাইকেলের ঘটনাটি তার মধ্যে একটি ।

পুনা বিশ্ববিদ্যালয় যারা দেখেছেন তাঁরা জানেন সেই ক্যাম্পাস কি প্রকান্ড । আমার মামাদের নিত্য যাতায়াত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের রাস্তায় সাইকেলে চেপে । তা একদিন রাতের অন্ধকার নেমেছে । পুনা শহরে তখন অন্ধকার নামত তাড়াতাড়ি, নাইট লাইফ বলতে সাইকেল চালানো, নয় বন্ধু বান্ধবদের জুটিয়ে ক্যাম্পাসে আড্ডা মারা । বাকি শহরবাসী রাত নটার মধ্যে নৈশাহার শেষে রেডিও শুনতে শুনতে চাদরের নিচে ঢুকে পড়ত।
এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ সাইকেল চালানোর পর ওরা বুঝতে পারলেন তাঁরা নিজেদের অজান্তে একটি বৃত্তে ঘুরে চলেছেন ফলত: একই জায়গায় বারবার ফিরে আসছেন । যেই জায়গাটাতে ফিরে এসে তাঁরা ধাক্কা খাচ্ছেন, সেই জায়গাটা কাঁটাতারে ঘেরা । পাক্কা আটবার একই ঘটনা ঘটার পর তাঁরা সকলে সাইকেল থেকে নেমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন । তখন পুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তার ভিতর দিয়ে মিলিটারি ট্রাক চলাচল করত, এইরকম একটি ট্রাককে আসতে দেখে সকলে মিলে প্রাণপণে হাত দেখিয়ে ট্রাকটিকে থামালেন । ট্রাকের চালক নেমে এসে তাদের কাছ থেকে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে, তাদেরকে পথ দেখিয়ে ওই অন্ধ বৃত্তের বাইরে নিয়ে যায় । বড়মামারা পরে দেখেছিলেন তাদের প্রত্যেকের সাইকেলের চাকায় ঠিক আটখানা করে ছিদ্র । তাঁরা পরে বুঝেছিলেন যে তাঁরা আটবার ওই বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছিলেন । কিন্তু তাঁরা তো কেউ দমে যাওয়ার পাত্র নন, কাজেই আবার সেখান দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেছেন । বড়মামা বলেছিলেন ‘আমাদের সাইকেল বারবার চক্কর খাইয়ে ভুত ব্যাটার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, আমাদের আর জ্বালায় নি, তবে এই চক্করের অভিজ্ঞতা আমরা ছাড়াও অনেকের হয়েছে । ভুতটা জানিস তো মেরি গো রাউন্ড খেলতে ভালবাসত’ ।
আমি এটা শোনার পর কোনদিন পার্কে গিয়ে মেরি গো রাউন্ডে চড়ি নি আর ।

মামার বাড়ীর গল্প বলতে হলে বড়মামার সাথে সাথে আমাদের দিদার কথাও না বললেই নয় । দিদার সাথে চেনা মানুষের অচেনা হয়ে দেখা দেবার গল্প শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যেত । কিশোরীবেলা থেকেই দিদার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল । দিদার বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উকিল । । ব্রিটিশ সরকার জেলে বন্দী করেছিলেন দিদার বাবাকে । পরবর্তীকালে স্লো পয়েজিনিং এর ফলে তিনি মারা যান । দিদার বয়েস তখন তিন বছর, দিদার ছোট ভাইয়ের এক বছর, আর দিদাদের সবচেয়ে বড় দিদি তখন পাঁচ বছরের । দিদার মা আমাদের ‘বুড়ি আম্মা’ অসম্ভব সাহসী মহিলা ছিলেন । স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াই করে স্বামীর সাথে জেল খেটেছেন, তিনটি দুধের শিশুকে বুকে নিয়ে একা মহিলা অসম লড়াই করেছেন সমাজের সাথে, পড়াশোনা শেষ করেছেন । নেতাজি সুভাষ বসু বুড়ী আম্মাকে ইস্কুলের চাকরীর ব্যবস্থা করে দেন, তাতেই দিদাদের খাওয়া, পড়ার সংস্থান হয়। তা এ হেন বাবা, মায়ের ছেলে মেয়ে দিদা আর দিদার ভাই জন্মেছিলেন বিচিত্র ক্ষমতা নিয়ে । দিদার চেয়ে দু বছরের বড় দিদির সঙ্গে দিদা হরিহর আত্মা ছিলেন । দিদারা দুই বোন ইস্কুল যেতেন একসাথে, ঘরের কাজ করতেন, ভাইয়ের দেখাশোনা করতেন । ভালোই চলছিল তাদের সংসার । হঠাৎ একদিন দিদা স্বপ্ন দেখলেন, গঙ্গার বুকে এক বিশাল নৌকায় তাঁর বাবা বসে আছেন আর বাবার পাশে তাঁর প্রাণপ্রিয় দিদি বসে রয়েছেন । দিদা প্রানপন তাদের ডাকতে থাকলেন, তাঁরা কেউ সাড়া দিলেন না । নৌকা ভেসে গেল দূরে, দূরে, অনেক দুরে । এই স্বপ্ন দেখার পরই সপ্তাহখানেকের মধ্যে দুদিনের জ্বরে ভুগে দিদার দিদি মারা যান । তখন তাঁর দিদির মাত্র তেরো বছর বয়েস । সেই থেকেই দিদা তাঁর এই অস্বাভাবিক স্বপ্ন দেখার ক্ষমতার কথা বুঝতে পারেন এবং তারপর থেকে পরিবারে যখনি কোন বিপর্যয় এসেছে দিদা কিছু না কিছু স্বপ্ন দেখেছেন । শেষ বয়েসে সবটা আর বলতে পারতেন না গুছিয়ে, কিছু কিছু কথায় বোঝা যেত যে দিদা কিছু স্বপ্ন দেখে থাকবেন এবং আমাদের পরিবারে কেউ পারি দেবে পরপারে, মাটির পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে।

দিদার ভাই আমাদের মামাদাদুর এক অদ্ভুত অভ্যেস ছিল ঘুমের মধ্যে তিনি দরজা খুলে বেড়িয়ে যেতেন আবার ফিরেও আসতেন । একদিন দিদাদের এক জ্যাঠতুতো দাদা ব্যাপারটা খেয়াল করে তাঁর পিছু নেন, তিনি দেখেন দিদাদের ভাই অর্থাৎ আমাদের মামাদাদু গঙ্গার পারে শ্মশানে গিয়ে বসে আছেন । তাঁকে গায়ে হাত দিয়ে ডাক দিতেই তিনি যেন ঘুম থেকে উঠে বসলেন, যিনি মামাদাদুর পিছু নিয়েছিলেন এবং মামাদাদুকে ডেকে তুলেছিলেন তিনি বলেছিলেন মামাদাদু চোখ খুলে যেন ঘুমোচ্ছিলেন এবং কিছুই বলতে পারেন নি কেন তিনি শ্মশানে এসেছেন এবং কি করে এসেছেন ।
দিদা যখন সবে নতুন বৌ হয়ে তাঁর ডাক্তার বরের সাথে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন অমবরনাথ থাকাকালীন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। দিদা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে উঠোন পেড়িয়ে শোবার ঘরের দিকে যাবার সময় দেখেন তাঁর সবচেয়ে বড় ননদ, অর্থাৎ আমার মায়েদের বড় পিসি সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন । দিদা তাঁকে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘সেকি তুমি এখানে কেন? কখন এলে?’ তিনি বললেন ‘তোমার ছোট ছেলেকে দেখতে এলাম, দেখা হয় নি তো’ । দিদা বললেন ‘চল ভিতরে চল’ । ব্যাস ওই শেষ কথা । আর কেউ কোত্থাও নেই, কাউকে আর দেখা গেল না । দিদা হাঁপাতে, হাঁপাতে ঘরে এসে দেখেন, দাদু হাসপাতাল থেকে ফিরে মাথা নিচু করে বসে আছেন, হাতে একটা টেলিগ্রাম । দিদার হাতে টেলিগ্রামটা দিতে দিদা দেখলেন টেলিগ্রামটা মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছে । দিদার অতি প্রিয় বড় ননদ, দাদুর বোন মারা গেছেন । দিদা যাকে একটু আগে উঠোনে দেখেছেন এবং কথা বলেছেন ।
দিদাদের পুনা প্রবাসকালে পুনার মত রহস্যময় শহর যে দিদাকে বঞ্চিত করবে না জানাই কথা । দিদাদের পুনার বাংলোর সামনে বিরাট ফুলের বাগান ছিল, গেট দিয়ে ঢুকতেই দুপাশে ক্রিসান্থিমামের বেড, মাঝখানে পাথুরে পথ। পেছনে ফলের বাগান, সে বাগানে একটা বিরাট আতা গাছ ছিল । সেই আতাগাছের নিচে দিদা একদিন কোন কাজে গেছেন, বোধহয় আমসত্ব শুকোতে দিতে জালের ঢাকা দিয়ে আড়াল করে । হঠাৎ দেখলেন বাগানের মালি শিবরাম দাদা এসে হাজির । দিদা তো মহাখুশি, শিবরাম দাদাকে বললেন আমসত্বর থালাগুলো রোদে দিয়ে আসতে, আতা গাছের ডালগুলো ছেটে দিতে এবং সামনের বাগানে ক্রিসান্থিমামের বেডগুলোর মাটি খুঁচিয়ে দিতে । দিদা এই বলে আরও কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন । শিবরাম এসে গেলে বাগান নিয়ে দিদা নিশ্চিন্ত । খানিক পরে শিবরাম দাদার বড়ছেলে এসে খবর দিয়ে গেল শিবরাম দাদা আর নেই, সেদিন ভোরেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন।

দিদার বাগানের ক্রিসান্থিমামের বেডে তখনো তাজা নিড়ানো মাটি জেগে আছে, আমসত্বর থালা মহানন্দে রোদ খাচ্ছে ।

ক্রমশ
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।