প্রবন্ধে ঈপ্সিতা বিশ্বাস

কলকাতার দাঙ্গা: এক দুঃস্বপ্নের ইতিহাস
‘কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য। মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়।’
শেখ মুজিবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৬৬ নং পাতায় এভাবেই ফুটে উঠেছে ৪৬এর কলকাতা দাঙ্গার করুণ প্রতিচ্ছবি।
এই দাঙ্গায় শুধু একটি পক্ষ মার খায়নি। উভয় ধর্মের মানুষ রক্তাক্ত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রতিশোধ আর পাল্টা প্রতিশোধের মনোভাব ছিল উভয়পক্ষের মধ্যে। এমনটাই উঠে এসেছে শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতে।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘যারা দাঙ্গা থামাতে গিয়েছিলেন কিংবা আক্রান্তদের সাহায্য করতে গিয়েছিলেন, তারাও বিপদে পড়েছিলেন।’
দিনটি ছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট। বাংলা তথা গোটা ভারতের ইতিহাসে একটি রক্তমাখা অভিশাপের দিন যা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ বা ‘কলকাতা হত্যাকান্ড’ নামেও পরিচিত। দিনটিতে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের কলকাতা শহরে মুসলমান ও হিন্দুদের সহিংস সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল যা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ঘটনা বাংলা তথা গোটা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণায় একটা বাঁক এনেছিল বলে মনে করা হয়। সে বছর ১৬ আগস্ট কলকাতায় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে হিংসার বিস্ফোরণে যত খুন হল, যত সম্পত্তি ধ্বংস হল, অতীতে তার নজির মেলে না।
মুসলিম লীগের সভাপতি মহম্মদ আলী জিন্নাহর এই ঘটনার পেছনে বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনিই ১৬ আগস্টকে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং কংগ্রেসকে হুঁশিয়ারি দেন,
‘আমরা যুদ্ধ চাই না। যদি আপনারা যুদ্ধ চান, তবে আমরাও যুদ্ধ করতে পিছুপা হব না। আমাদের হয় বিভক্ত ভারত অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারত থাকবে।’
মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্টকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। উপমহাদেশের সর্বত্র মুসলমানগণ ঐদিন সকল কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে, হিন্দু জনমত পাকিস্তান-বিরোধী স্লোগানকে কেন্দ্র করে সুসংগঠিত হতে থাকে। বাংলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তেমন একটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু দলের অধিকাংশ সমর্থক ছিল হিন্দু, তাই কংগ্রেস সদস্যদের একটা অংশ পাকিস্তান আন্দোলনকে আসন্ন বিপদ হিসেবে উপলব্ধি করে হিন্দুদের একাত্মতা বিষয়ে প্রবল অনুভূতি প্রকাশ করার প্রয়াস পায়। তাদের প্ররোচনা নিঃসন্দেহে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের বিরুদ্ধে হিন্দুদের চেতনাকে প্রজ্বলিত করেছিল। বিশেষত লীগ মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় থাকার কারণে ওই দিবস বাংলায় সফল হওয়ার সম্ভবনা ছিল।
১৬ আগস্ট ভোরে উত্তেজনা শুরু হয় যখন লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা উত্তর কলকাতায় হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। ওই দিন অক্টারলোনি মনুমেন্টে লীগের সমাবেশে এ যাবৎকালের মধ্যে মুসলমানদের সর্ববৃহৎ জমায়েত ছিল। দুপুর ২টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়, যদিও দুপুরের নামাজের পর থেকেই কলকাতার সব জায়গা থেকে মুসলমানদের মিছিল জড়ো হতে শুরু করেছিল। অংশগ্রহণকারীদের একটি বিশাল অংশ লোহার রড ও বাঁশের লাঠি নিয়ে সজ্জিত ছিল বলে জানা যায়। একজন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ৩০,০০০জন এবং কলকাতা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শনের তথ্য অনুযায়ী ৫০,০০,০০০জন সমাবেশে উপস্থিত ছিল বলে অনুমান করা হয়েছিল। পরবর্তী পরিসংখ্যানটি অসম্ভব বেশী ছিল এবং স্টার অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদক এই সংখ্যাকে প্রায় ১,০০,০০০বলে উল্লেখ করেছিল। প্রধান বক্তা হিসাবে খাজা নাজিমুদ্দিন ও মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সুরাওয়ার্দি ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁর বক্তৃতায় প্রাথমিকভাবে শান্তিপূর্ণতা ও সংযমের কথা বললেও পরবর্তীতে প্রভাব বিনষ্ট করেন ও উত্তেজনা ছড়িয়ে দেন এই বলে যে, সকাল ১১টা অবধি আহত সমস্ত ব্যক্তিই মুসলমান এবং মুসলিম সম্প্রদায় শুধুমাত্র আত্মরক্ষায় প্রতিশোধ নিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে ‘নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে’ এ কথার মাধ্যমে শ্রোতৃমন্ডলীকে আশ্বস্ত করেন বলে প্রকাশ। সমবেত জনতা এটাকে প্রতিপক্ষ সম্প্রদায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রকাশ্য আহ্বান বলে ব্যাখ্যা করে। এ হিংসাত্মক কার্যাবলী দ্বারা যে এলাকা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল তা হল, দক্ষিণে বউবাজার স্ট্রিট, পূর্বে আপার সার্কুলার রোড, উত্তরে বিবেকানন্দ রোড ও পশ্চিমে স্ট্রান্ড রোড দ্বারা বেষ্টিত রাজধানীর বহুল জনাকীর্ণ অংশটি। সরকারী হিসাব মতে এ দাঙ্গায় ৪,০০০ লোক নিহত ও ১,০০,০০০ আহত হয়। কিছু কিছু হত্যার ঘটনা ছাড়া ২২ তারিখের পর কলকাতার পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের সময় বহু মানুষ কলকাতা ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে থাকে। বেশ কয়েকদিন ধরেই অগণিত মানুষের ঢেউ হাওড়া ব্রিজ দিয়ে স্টেশন অভিমুখের দিকে যেতে থাকে। তাদের অনেকেই কলকাতার বাইরের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া এই হিংস্রতা থেকে বাঁচতে পারেননি। লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট সাক্ষাৎকারে দাবি করেন যে, মহাত্মা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন, ‘ভারত যদি রক্তপাত চায় তবে সে তা গ্রহণ করতে পারে…যদি রক্তপাতের প্রয়োজন হয়, তা অহিংসা সত্ত্বেও ঘটবে।’
১৯৪৬ সালের এ দাঙ্গা দ্ব্যর্থহীনভাবে সম্প্রদায়িক ছিল। পূর্ববর্তী দাঙ্গা-হাঙ্গামার তুলনায় ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা যে দিক দিয়ে অত্যাধিকভাবে স্বতন্ত্র, তা হল এর সুসংগঠিত রূপ। এ ‘দিন’-টিকে ,সাফল্যমন্ডিত করতে লীগ তার সকল সম্মুখ প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত রেখেছিল।
রাজনৈতিক উসকানির প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি আঙুল ওঠে হুসেন শহীদ সুরাওয়ার্দির দিকে। অনেকে এমনও বলেন যে সুরাওয়ার্দিই দাঙ্গার রূপকার, তাঁর পরিকল্পনা-মাফিকই প্রায় সবকিছু ঘটেছে। সুরাওয়ার্দি কেন্দ্রে থাকলেও এঁদের নিশানায় থাকে গোটা মুসলিম লীগ। এর উৎস হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে চরম হিংসাত্মক মনোবৃত্তি।
‘দাঙ্গা একদিনে শেষ হয়নি। মধ্যবিত্ত বাঙালী হিন্দু এইসময় বাংলা দ্বিখন্ডিত করার পক্ষে রায় দেয়। সিদ্ধান্ত হয়–পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের অংশ হবে আর পূর্ববঙ্গের নতুন নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান। এইসব সাতবাসি কথা পুনরাবৃত্তি করছি, কারণ দেখেছি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ে এইসব অতিপরিচিত তথ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন।’
—-তপন রায়চৌধুরী(২০০৭:১৫৮-৫৯)
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ও পরস্পরের বিচ্ছেদ দেখে নিতান্ত দুঃখিত, মর্মাহত, লজ্জিত হই। ধর্মে ধর্মে বিরোধ হতে পারে না। কারণ, ধর্ম হল মিলনের সেতু আর অধর্ম বিরোধের। যখন ধর্মে বিকার উপস্থিত হয়, তখনই বিচ্ছেদ প্রবল হয়ে ওঠে। শুধু হিন্দু মুসলমানে প্রভেদ নয়, সমাজে ভেদের অন্ত নেই। যখন মানুষ মানুষকে অপমান করে, তখন সে দুর্গতি দারিদ্রের চরম সীমায় উপনীত হয়; আমি আমার সমাজের জন্য লজ্জিত হয়েছি। বিচ্ছেদের রক্তপ্লাবনে মানব সমাজের প্রতি স্তর কলুষিত হয়েছে। এই সমস্যা ভারতে বহুদিন থেকে আছে। বিরোধের প্রাচীর তুলে ত সমস্যার সমাধান হবে না। শুভবুদ্ধির আলোক বিকীর্ণ হোক। তবেই আমাদের চিত্ত মুক্ত হবে। সংকীর্ণতার মধ্যে বাহিরের চুক্তি দ্বারা সে ঐক্য হবে না। আমাদের শুভবুদ্ধি শুভকর্মে যুক্ত হোক।’
তথ্যসূত্র: শেখ মুজিবরের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, আনন্দবাজার পত্রিকা, গুগুল।