আমাদের ছোটোবেলাগুলো সত্যিই কত তুচ্ছ আর সাধারণ জিনিস দিয়ে ভরা ছিল। তাতেও কি আনন্দ ছিল তা ভাষায় প্রকাশ হবার নয়। মনে পড়ে যায় পয়লা বৈশাখ দিনটার কথা। না, নতুন কোনো কিছুতেই ভরা ছিল না আমার জীবন। জুতো জামা প্যান্টের তো প্রশ্নই আসে না। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, পয়লা বৈশাখে যে নতুন কিছু অঙ্গে দিতে হয় সেটাই আমি জানতাম না। অনেক বড় বয়সে যখন বন্ধুদের নতুন জামা প্যান্ট পরতে দেখতাম তখন বেশ কিছুটা অবাকই হতাম। অবশ্য জানলেও কিছু করার উপায় ছিল না। পুজোতেই যাদের অতি কষ্টে নামমাত্র একটা কিছু জুটতো অন্য সময় আর নতুন কিছুর কথা আমরা ভাবতেও পারতাম না।
আমি খুব সৌভাগ্যবান এই কারণে যে, এমন একটা সময় আমি পৃথিবীতে এসেছি যখন আমাদের গ্রামে পয়লা বৈশাখটাই একটা বড় উৎসব। পয়লা জানুয়ারি কখনও আলোচনাতেও আসতো না।
সকাল থেকেই দেখতাম দোকানগুলোতে রঙিন কাগজ দিয়ে সব সাজাত। কলাগাছ, ঘটের মুখে ডাব। কোথাও মাইক আবার কোথাও ছোটো ছোটো বক্সে বাংলা গান বাজত। বেশ একটা সাজো সাজো ব্যাপার। সকালবেলা একবার দোকানতলা ঘুরে গিয়ে মন একেবারে আনন্দে নেচে উঠতো।
বিকেলবেলা বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তাম হালখাতা করতে। কোন কোন দোকানগুলো যেতে হবে আগে থেকেই জানতাম। কারণ নববর্ষের কার্ডগুলো তো বাবা আমার হাতে এসেই দিতো। আর আমি সেগুলো জমিয়ে রাখতাম।
দোকানের সামনেই একটা বড় জায়গায় সরবত গোলা থাকত। সরবতের ওপর বরফগুলো ভাসত। আমি চেয়ারে বসে থাকতাম। বাবা হাতে একটা সরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিত। এক গ্লাসে মন উঠতো না। আরও এক গ্লাস খেতাম। খেতে খেতেই দেখতাম বাবার হাতে ক্যালেণ্ডার আর মিষ্টির প্যাকেটটা এসে উঠলো কিনা। মিষ্টি বলতে বোঁদে পাকানো যাকে আমরা দরবেশ বলতাম। সেই সময় মুখে অমৃত লাগতো। যদিও মিষ্টির থেকে আমার অনেক অনেক বেশি আনন্দ হতো ক্যালেণ্ডার পেয়ে। বাড়ি ফেরার সময় সরবত আর মিষ্টি খেয়ে এতো পেট ভরে যেত যে হাঁটতে কষ্ট হতো। বাড়ি ফিরেই ক্যালেণ্ডার গুনতে বসে যেতাম। কি আনন্দ যে হত। সে সব দিন কোথায় যে হারিয়ে গেল! মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়।