সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৭৮)

সোনা ধানের সিঁড়ি

১১৪

কবি অরুণ মিত্র তখনও জীবিত। বয়স নব্বইয়ের ঘরে। আমার মা অরুণ মিত্রকে চিনতেন এবং এটাও জানতেন তার ছেলের সঙ্গে ওই বিরাট মানুষটার খুব সামান্য হলেও একটা যোগাযোগ আছে। আসলে এর একটা কারণ আছে। আমি সময় সুযোগ পেলেই মায়ের কাছে অরুণ মিত্র আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গল্প করতাম এবং তাঁদের কবিতাও পড়ে শোনাতাম। একদিন হঠাৎ মায়ের কানে গেল, আমি অরুণ মিত্রকে অরুণদা বলছি। ব্যাস, মায়ের বকবকানি শুরু হয়ে গেল। মায়ের বক্তব্য, ঠাকুরদার বয়সী একটা মানুষকে আমি কেন দাদা বলব। এটা মানুষটার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন নয়। আমি যত বলি, আমাদের কবিতার জগতে কাকা জ্যাঠা বলে কিছু হয় না। কিন্তু মা কিছুতেই শুনতে চায় না। সে যাই হোক, যে কারণে এই প্রসঙ্গের অবতারণা —— আমার জীবনে কোনো কাকু জেঠু নেই। বাবার দাদা আর ভাই ছাড়া আমি জীবনে কখনও কাউকে কাকু জেঠু বলি নি। সেসব পাঠ কবেই চুকে গেছে। আমি নিজে শুনতেও ভালোবাসি না। প্রেমের সম্পর্ক বাদ দিলে, আমার জীবনে আছে একটাই সম্পর্ক দাদা আর দিদি।
ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের ধারণা, আমার কতটুকু যোগ্যতা আছে কোনো সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করার। ছোটােবেলা থেকে একটা সম্পর্কে খুব সামান্য হলেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সেটা হলো দাদা। হয়ত বলে বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলে। অথচ চোখের সামনে দেখি কত কত মানুষ কত অনায়াসে একবেলাতেই মা বাবা মেয়ে ছেলের সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলছে। তখন নিজেকে মনে হয় আমি এই পৃথিবীর ক্ষেত্রে সত্যিসত্যিই কতটা অনুপযুক্ত। কারণ সবাই পারে কিন্তু আমি পারি না কেন। আমিই বোধহয় এতো ভাবি। কি দরকার এতো ভাবার। খুব দ্রুততার সঙ্গে কিছু একটা পাতিয়ে নিলেই তো হয়। কিন্তু এতদিনেও নিজেকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি।
ত্যাগস্বীকার ছাড়া সত্যিই কি কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হয়? নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দিলে তবেই না সেই পথ ধরে কেউ আসতে পারে। এসব কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই আজকের মানুষেরা সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলে। কতদিন স্থায়ী হয়? স্থায়িত্বের কথা যদি ছেড়েও দিই তাহলেও বলা যায় একসপ্তাহ কি একমাস, খুব বড়জোর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তারা দুজনেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে নিজের নিজের পথে চলতে শুরু করে। আসলে এটাই হয়ত স্বাভাবিক। সম্পর্কের জন্য আমরা কতটুকু সময় ব্যয় করি? আমার আরও একটা প্রশ্ন —— আমৃত্যু নারী পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক বাদ দিলে শুধু দাদা দিদিতে আটকে থেকে মানুষের কাছে যাওয়া যায় না? নাকি নিজেকে সংযত করার জন্যই মা বাবা ছেলে মেয়ে প্রভৃতি সম্পর্কের হাত ধরা?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।