সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৮৬)

সোনা ধানের সিঁড়ি 

১২৫

কুঁড়িগুলো দু’হাতের পাতায় ধরি। আমার হাতে এসে তারা যেন ডানা মেলে দেয়। যেন তারা আমার কতদিনের চেনা। সেই কোন ছোটবেলায় ওদের সামনে দাঁড়িয়ে কি যে ভরসা পেতাম। মনে হতো আমার মতোই সেও কোনো গাঁয়ের ছেলে। সবাই যখন কথায় কথায় আমাকে উড়িয়ে দিত তখন তাদের কাছে দাঁড়িয়ে মাটিতে দাঁড়ানোর সাহস পেতাম। একটা দুটো নয়, কত কথা হতো। একতরফা তো কোনো কিছু হয় না। তারাও আমাকে তাদের খেলার সঙ্গী বলে ভাবত। ওদের কাছে দাঁড়িয়েই তো প্রথম বুঝতে পারি আমারও মূল্য আছে। আমার জন্যেও কেউ অপেক্ষা করে থাকতে পারে। আমার কথাও কেউ শুনতে চায়।

পথে চলতে হাঁটতে যখন কথা বলতে পারতাম না আর আকাশ জুড়ে যখন মেঘ করে এসে চারপাশ আবছা করে দিত তখন মনের মধ্যে খুব কষ্ট হতো। পায়ে পায়ে কুঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম। তারা বুঝতে পারতো আমার মন খারাপ। তাদের কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারি, মনখারাপ হলে নাকি গল্প বলতে হয়। কিন্তু কাকে আমি গল্প বলতে যাব ? আমার গল্প কে শুনবে ? আমার মন্তব্য শুনে তো তারা হেসে গড়িয়ে পড়ে। গল্প শোনানোর জন্যে কি কারও প্রয়োজন হয় নাকি ? নিজেকে শোনাবে। সেই আমার প্রথম জানা, গল্প নিজেকেও শোনানো যায়। গল্প তো এর ধারাবাহিক পথ চলা। কত নদী পাহাড় জল জঙ্গল সমভূমি মালভূমি পেরিয়ে চলা। কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি, আলো ছায়ার মধ্যে দিয়ে একনাগাড়ে এগিয়ে চলা। পথে কত কিছু চোখে পড়বে। কেউ না কেউ তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে। তখনই তো তোমার মন আলো হয়ে উঠবে। নদীর মতো এইভাবে বয়ে না গেলে কে তোমার খোঁজ পাবে। বুকের দুঃখকে এইভাবে উড়িয়ে নিয়ে গেলে তবেই তো দুঃখ একদিন উড়ে যাবে।

এক একটা কুঁড়ির মধ্যে দেখেছি এক একটা পৃথিবী। কত রকমের জলহাওয়া। রোদের কি দারুণ উচ্ছ্বাস। আবার যখন মেঘ করে আসে চারপাশে সে কি আয়োজন। বৃষ্টিপথের ওপর কুঁড়ি তার হৃদয় মেলে দেয়। দেখে মনে হবে এই যেন তার মিলনের সময়। কোনো দিকে তার যেন কোনো খেয়াল নেই। নিজের সুরেই যেন সে বিভোর হয়ে আছে। অথচ ওপর থেকে কে বুঝবে তার হৃদয়ের এই ঋতুপরিবর্তন। যেন মগ্নতার এক চূড়ান্ত রূপ।

নদীর ধার ধরে ধরে অনেক পথ হেঁটে তবে তো এইরকম এক বৃহতের কাছে এসে হাজির হওয়া যায়। এ যেন এক পরীক্ষা, যেন এক অবিরাম হাঁটা। যেন এক অপেক্ষা পেরিয়ে যাওয়া। অপেক্ষা মানে তো কোনো এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে এক নির্দিষ্ট সময়ের শেষে মিলনের তীব্র ইচ্ছা। কিন্তু এই হাঁটায় কোনো বিশেষ সময়ের শেষে কোথাও পৌঁছানো নেই। তাই এখানে নেই কোনো অধৈর্য্যতা। এক বিশেষ ইচ্ছায় বলীয়ান হয়ে অবিরাম পথ চলা। পথই এখানে তোমার সঙ্গে কথা বলে নেবে। কথার পাহাড় থেকে নেমে যখন আমি সমতলে, যখন আমার মনে হবে মুখ খোলা মানেই অতিরিক্ত, ঠিক তখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে কুঁড়ি। কোনো কথা নেই। থাকবে চূড়ান্ত মগ্নতা। দুটি মুখ গভীর নির্জনতায় অবগাহন করে মুখোমুখি বসে থাকবে অনন্তকাল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।