• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৭২)

সোনা ধানের সিঁড়ি

১০৮

তখনও ঘরে ঘরে না হলেও অনেকের বাড়িতেই টেপরেকর্ডার খুঁজে পাওয়া যেত। আমার বাড়িতেও একটা ছিল। “বিভূতিভূষণ” গানটা যেদিন প্রথম হাতে পাই সেদিন কতবার যে শুনেছিলাম তা গুনে শেষ করা যাবে না। মা বলত, এবার ক্যাসেটের ফিতেটা তো ছিঁড়ে যাবে। সত্যিই তাই। আমারও যে বিষয়টা মনে উঁকি দেয় নি তা কিন্তু নয়। কিন্তু এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আমি প্রথমে গানটা থেকে নিজেকে কিছুতেই সরিয়ে আনতে পারি নি। কথা ও সুরের এই অসাধারণ মেলবন্ধন সুমন ছাড়া আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি (এখানে বলে রাখা ভালো, আমার সীমিত জ্ঞান আর দেখায়)। “বিভূতিভূষণ” গানের শেষ অংশটায় —– “দিনের আওয়াজ যেই ঝিঁঝিঁর কোরাসে মিশে যায় / হঠাৎ জেনারেটর ওগরায় শব্দ দূষণ / টুরিস্ট লজের ঠিকে কাজ করে ফেরে সাঁওতাল / এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ” —— আমি একেবারে পুরোপুরি ডুবে যেতাম। সুমনের গানের কথার যে চিত্রধর্মীতা তা সুরের তরঙ্গে মিশে গিয়ে চোখের সামনে এমন একটা ছবি তুলে ধরতো যা মন থেকে কখনও মুছে যাওয়ার নয়। গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে সন্ধে নেমে আসা আর মাটির পথ ধরে সাঁওতাল ছেলের ঘরে ফিরে আসা —— কখন যে পায়ে পায়ে আমিও তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছি তা নিজেও জানি না। “এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ” —– গানের কথা থেমে গেছে কিন্তু একটা সুর তখনও বেজে চলেছে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকতাম। চোখের সামনে দেখতে পেতাম, বিভূতিভূষণ ধুলোপথে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মধ্যে মিশে যাচ্ছেন।
১৯৮৭ – ৮৮ সালে এইচ এম ভি-র সুপ্রিম সিরিজের ক্যাসেটগুলোর দাম ছিল ষাট টাকার ওপরে। তখন ষাট টাকার অনেক মূল্য। একমাস একজনকে পড়িয়ে পঞ্চাশ টাকা পেতাম। সমস্ত উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্যাসেটগুলো এই সুপ্রিম সিরিজের মধ্যে পড়ত। মাসে মাসে টাকা জমিয়ে ক্যাসেট কিনতাম। এর পাশাপাশি টি সিরিজের ক্যাসেটগুলোর দাম একটু কম ছিল। একদিন খোঁজ পেলাম টি সিরিজ থেকে বিসমিল্লা খানের একটা সানাইয়ের ক্যাসেট বেরিয়েছে। আর অপেক্ষা নয়। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম। ক্যাসেটের দোকানের মালিক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ভাই তোমার কি মাইকের ব্যবসা আছে? প্রথমে বুঝতে পারি নি, পরে বুঝতে পারলাম সানাইয়ের ক্যাসেট তো ঘরে শোনবার জন্যে কেউ কিনে নিয়ে যায় না। একমাত্র যারা মাইক ভাড়া দেয় তারাই বিয়ে বাড়িতে বাজানোর জন্যে সানাইয়ের ক্যাসেট কেনে। আমি বাড়িতে শোনার জন্যেই কিনছি শুনে লোকটা একটু অবাকই হয়েছিল।
পূর্নিমার দিন গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত তখন আমি সানাই শুনতাম। এমন কত রাত সানাই শুনতে শুনতে ভোর হয়ে গেছে। যেহেতু মনখারাপ হলেও আমি সানাই শুনতাম তাই রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মা যখন শুনত আমার ঘর থেকে সানাইয়ের সুর ভেসে আসছে তখন আমার দরজায় টোকা দিত। আমি না ঘুমানো পর্যন্ত মা শুতে যেত না। এত কথা এই কারণে বললাম, সানাইয়ের সুর আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আজও জড়িয়ে আছে। সেই সানাইকে নিয়ে সুমন লিখে ফেললেন, “হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাই / বিসমিল্লার পাগলা সানাই”। সত্যিই তো প্রিয় জিনিসই মানুষ হাতে নিয়ে চেটেপুটে খায়। যে ভালোলাগা জড়িয়ে আছে প্রাণের সঙ্গে তাকে এত সহজ ভাষায় আর অন্যরকম ভাবে কি প্রকাশ করা সম্ভব? আমার তখন বারবার মনে হতো, আজও মনে হয় —– সানাই সম্পর্কে এটাই যেন শেষ কথা। উনি সবটুকুই বলে দিয়েছেন। “ছোট্ট বেলায় শুনেছি প্রথম / কেউটে সানাই সুর পঞ্চম/ খেয়েছে লোকটা এই মাথাটাই / ধরেছে নেশায় খ্যাপাটে সানাই /
হাত পেতে নিয়ে চেটে পুটে খাই / স্মৃতি বিজরিত পাগলা সানাই” —— হাজার চেষ্টা করেও সানাইয়ের প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি নি অথচ সুমন কত অনায়াসে লিখে ফেললেন এসব কথা। শুনতে শুনতে মনে হয়েছে এ তো আমারই কথা, আমি তো ঠিক এটাই বলতে চেয়েছি। “কৈশোরে দেখা আকাশ কুসুম / জানিনা কেন যে আসতো না ঘুম / অচেনা কষ্ট কি যাচ্ছে তাই / রাতেরে নিয়েই শুনলে সানাই” —– বুঝতে পারতাম শুধু আমি নয়, আমার মতো আরও অনেকে সানাই শুনতে শুনতে রাত ভোর করে ফেলেছে। গানটা যেদিন প্রথম শুনি সেদিন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে, গানের মাঝখানে যে সানাইয়ের টুকরোগুলো ছিল তা আমাকে একেবারে ভেতর থেকে ভেঙে চুুুরমার করে দেয়। সুমনের গানকে আজও আমি এইভাবেই শুনি আমার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী করে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।