স্কুল জীবন থেকেই মনের মধ্যে একটা ইচ্ছা ছিল, লেখকদেরকে চোখের সামনে থেকে দেখব, তাদের সঙ্গে কথা বলব। কারণ তারা তখন আমার কাছে স্বর্গের বাসিন্দা। তাই ক্লাস এইট নাইন থেকেই লাইব্রেরির (স্কুলের নয়) বই পড়তে শুরু করে দিই। যে সমস্ত বই পড়ে খুব ভালো লেগে যেত তাদের লেখকদের চিঠি লিখতাম। চিঠির বিষয় হতো, বইটি পড়ে আমার অভিব্যক্তি। সেই সঙ্গে লেখকদের নিয়ে আমার মনের ইচ্ছার কথা।
১৯৮৮ সাল। আমি তখন কলেজ পড়ুয়া। পুরোপুরি গ্রামের মানুষ। দিনরাত পড়ার বইয়ের পাশাপাশি জোরকদমে গল্প কবিতা পড়া চলছে। একেবারে নেশার মতো। সেই সময় সদ্য প্রিয় হয়ে ওঠা বইয়ের লেখককে চিঠি লিখতাম। বই পড়ে আমার যা মনে হতো তাই লেখককে জানাতাম। একদিন বুদ্ধদেব গুহকেও একটি দীর্ঘ চিঠি লিখে ফেলি। কোজাগর, মাধুকরী, অববাহিকা —– এসব কোনো উপন্যাস নয়। আমি আটকে গেলাম “শালডুংরী”-তে (প্রথম পর্ব) । ওই বয়সে এই বইটি আমার আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। চারদেওয়ালের বেড়া ডিঙিয়ে আমি মাঝে মাঝেই খোলা আকাশের নীচে গিয়ে দাঁড়াতাম। তিন তিনবার বাড়ি ফেরার কথাও ভুলে যাই। প্রথম দুটি একবেলার জন্যে (সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরা) আর তৃতীয়টি চারদিনের জন্যে। “শালডুংরী” উপন্যাসে এরকমই একজন মানুষের সন্ধান আমি পাই। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার এই ইচ্ছার কথা ওই বয়সে যখন কাউকে বলতে পারছি না তখন উপন্যাসটির বিদেশি নায়কটিকে রাতের গভীরে মনের সব ইচ্ছার কথা খুলে বলতাম। আর এসব কথা লিখতে লিখতে অনেক সাদা পাতা ভরিয়ে ফেলি এবং একদিন সাহস করে সেসব পাঠিয়ে দিই স্বয়ং বুদ্ধদেব গুহকে। তারপর ভুলেও যাই। একদিন হঠাৎ করেই সেসব মনে পড়ায় নিজের মনে খুব একচোট হেসেছিলাম (একজন গাঁইয়ার হিজিবিজি ভাবনাকে লেখক হয়তো পাগলামো ভেবেছেন —– এই ভেবে)। কিন্তু সব ভাবনাকে মিথ্যে করে দিয়ে একদিন দুপুরে পিয়ন আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল পৃথিবী রাজ্যের অধীশ্বরের যাবতীয় ধনসম্পত্তির কাগজপত্র। এই ঘটনার পর অনেক অনেকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে। তিনি আমাকে মনে রেখেছিলেন একটা কারণে, আমিই তাঁর একমাত্র পাঠক যে তাঁর সব উপন্যাসকে সরিয়ে রেখে “শালডুংরী”-র দ্বিতীয় পর্ব লেখা নিয়ে তাঁকে পাগল করে তুলেছিল (এ তাঁরই মুখের কথা)। বইমেলায় দেখা হলেই বলতেন “এবারেও তোমাকে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে।”
জানা হলো না, “শালডুংরী” দ্বিতীয় পর্বে উনি ঠিক কি লিখতেন আর অরণ্যে মুখোমুখি বসে তাঁর গান শুনে সত্যিই আমার আর জনঅরণ্যে ফিরে আসার ইচ্ছা জাগত কিনা।