সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৯৪)

সোনা ধানের সিঁড়ি

 

১৩৩

খুব ছোটোবেলায় তখন ধনিয়াখালির গ্রামের বাড়িতে থাকি। সন্ধ্যেবেলার বৃষ্টি আমার কাছে এক বিশেষ প্রাপ্তি। কিন্তু সে বৃষ্টি দীর্ঘ সময়ের জন্যে কখনই নয় এবং অবশ্যই বর্ষার বৃষ্টি নয়। ভয়ঙ্কর দাবদাহের মধ্যে এমন কয়েকটা দিন বিকেল হলেই বেশ আকাশ কালো করে ঝড় উঠতো আর ঠিক তারপরেই কিছুক্ষণের জন্যে বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি আমার কৈশোর যৌবনকালকে ভরিয়ে রাখতো। সেদিন আমি আর পড়াশোনা করতাম না। বৃষ্টি থামলেই বেরিয়ে পড়তাম। রাস্তায় কাদাকাদা ভাব থাকতো না। কারণ মাটি তো গ্রীষ্মের রোদ খেয়ে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের বৃষ্টি তাকে আর কতটা গলাতে পারে। নির্ভাবনায় যেখানে খুশি পা রেখে রেখে এগিয়ে যেতাম। মনটা তখন এতো আনন্দে ভরা থাকতো যে যার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলিনি তাকেও দাঁড় করিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করতো। মনে হতো চারপাশ খুব শুনশান। আর মনে হতো, এখনই যেন কোথাও একটা গল্প শুরু হবে। আমি হেঁটে চলেছি যেন সেই জায়গাটারই খোঁজে। কেন যে এমন মনে হতো আমি আজও জানি না। বৃষ্টির পরে এমন অনেক সন্ধ্যে অজানা এক গল্পের খোঁজে বহু পথ হেঁটেছি কিন্তু সেই জায়গার খোঁজ আজও পাইনি।

কতকাল পরে গত ২১ মে শনিবার গ্রীষ্মের সন্ধ্যেতে নেমে এলো কিছুক্ষণের অকাল বৃষ্টি। আমার সেই আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। এ যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মুহূর্ত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম সেই গল্পবাড়ির খোঁজে। পাতা থেকে তখনও গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। কখনও একটা দুটো ফোঁটা নিজের গায়েও। জলের ভেতর ডুবে যাচ্ছে জুতো সমেত পা। কিছুটা হাঁটতেই কানে এলো “নয় এ মধুর খেলা / তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা”। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। এ কার কন্ঠস্বর! কত কত দুপুর, গ্রামের নিশুতি রাত এই কন্ঠস্বরে ভরে থেকেছে। আমাকে পাগল করে দিয়েছে, কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের মতো ছিটকে গেছি একঘেয়ে চারদেওয়ালের চিরাচরিত কাহিনীর বাইরে। কখন পা থেমে গেছে জানি না। আবার কানে আসছে সেই জলদগম্ভীর কন্ঠস্বরের স্পষ্ট উচ্চারণ —— “কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি /সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা।” চোখের সামনে ভেসে উঠছে জর্জ বিশ্বাসের ছবি।

চারপাশ অন্ধকার। অনেকক্ষণ কারেন্ট গেছে। গলির শুরুতেই বাঁদিকের বাড়িটি আমার কবিবন্ধু সৌম্য সরকারের। ওই বাড়িরই কিছুটা আলো এসে রাস্তায় পড়েছে। কন্ঠস্বরটি তাঁর বাড়ি থেকেই আসছে বলে মনে হলো। পায়ে পায়ে তাঁর বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কন্ঠস্বরটি আরও স্পষ্ট হলো। বন্ধু বললেন, আমি নাকি ঠিক সময়েই এসেছি। উনি এইমাত্রই বসেছেন। কে উনি? বন্ধু নাম বলেছিলেন আমি ভুলে গেছি। ছাতা রেখে ভেতরে গিয়ে বসলাম। বৃষ্টি লোডশেডিংয়ের মধ্যেও বেশ কিছু মানুষ এসে উপস্থিত হয়েছেন। বৃষ্টি-সন্ধ্যের মধ্যে এ শুধু গান নয়, একটা সুরের প্রবাহ। ওই আবার শুরু হলো —— “দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে। / আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।” মনে পড়ে কত কত বৃষ্টিমুখর অন্ধকার মাটির দুয়ারে বসে আমি আর মা জর্জ বিশ্বাস শুনেছি। তাঁর কন্ঠস্বর মায়ের খুব প্রিয় ছিল। চারপাশের নৈঃশব্দের মধ্যে আমরা দুজনেই কেঁদেছি। যদিও অন্ধকার অনেক কিছুই আড়াল করে দেয়।

একদিন পীযূষকান্তি সরকারের গান নিয়ে এসে মাকে শোনাই। খুব ভালো লেগে যায় তার। মা পুরুষ কন্ঠের রবীন্দ্রসংগীত বেশি পছন্দ করত। গান শুনতে শুনতে মা কখনও কথা বলত না। অন্ধকারে বসে যখন আমরা গান শুনতাম তখন মনে হতো না আমাদের সামনে রেডিও বসানো আছে। মনে হতো দূর প্রদেশ থেকে কোনো সুরের প্রবাহ এসে আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আজও গান শুনি কিন্তু মা থাকে না। আর কোথায় সেই নৈঃশব্দ! কোনো কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। অনেক দিন পরে আবার আমার বন্ধু সৌম্য সরকারের সৌজন্যে বৃষ্টি-সন্ধ্যের ভেজা হাওয়ায় অনেকটা সময় সুগত মজুমদারের সুরের প্রবাহে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।