T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় গৌতম সমাজদার

বয়ঃসন্ধি

অনেকদিন পর মল্লিকা মামার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। অতি মাড়িতে অনেকগুলো মাস বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি। তাই খুব আনন্দ, বেশি দূরে নয় মাঝে তিনটে স্টেশন। তাই বাবার অফিস থাকায় ও একাই যাবে। বাবা অফিস যাওয়ার সময় ট্রেনে তুলে দিয়ে যাবে, যদিও একা খুব একটা বাইরে বেরোয় না, তাই একটু চিন্তা হচ্ছে। মল্লিকা খুব ছোট বয়সে মাকে হারিয়েছে, বাবা একাই ওকে যত্ন করে মানুষ করেছে, ওর জন্য আর বিয়ে করেননি। মল্লিকা নবম শ্রেণী, নতুন শাড়ি। ওকে দেখলেই বয়সের তুলনায় বড়ই মনে হয় আর কম বয়সেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। শাড়ি পড়ে ভালো করে আচল গুঁজে, দেখতে বেশ ভালই লাগছে। বাবা ট্রেনে তুলে দিয়ে গেলেন, জানলা দিয়ে সিটে বসা লোকেদের বললেন, ওকে একটু টিটাগড় স্টেশনে নামিয়ে দিতে এই সময়ে ট্রেনটা শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে ভিড় কম। প্রায় সবাই বসে, গোটা পাঁচেক মেয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে খুব গল্প করছে, কখন সৌমিত্র কখনো মারাদোনা বা শাহরুখ খানকে নিয়ে। ও উঠতেই একটা সিট পেয়ে বসে পরলো। ওর মনে হলো ওরা একসাথে পাঁচটা সিট পায়নি বলে কেউ বসেনি। দমদম থেকে বেলঘড়িয়া স্টেশন আসতে অনুভব করলো ওর শাড়ির পিছনটা কেমন ভিজে ভিজে লাগছে। ভাবলো শাড়িটা পড়ার সময় কোন কারনে জল লেগে ভিজে যায় নি তো, নাকি ট্রেনে উঠে বোতল থেকে জল খাওয়ার সময় জল পড়ে ভিজে গেছে কিনা ভাবনায় এল। এদিক ওদিক ঘুরে শাড়িটার সবদিক দেখতে লাগলো, কিন্তু চোখে পড়লো না, কিন্তু লক্ষ্য করলো কলেজের মেয়েগুলো ওর দিকে তাকিয়ে খুব হাসাহাসি করছে, হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়ছে। ও অবাক হয়ে ভাবছি, কি কারনে ওকে দেখে এতো হাসাহাসি! ও আবার নিজেকে আগা পাঁচতলা দেখতে চেষ্টা করে। কিছুই না দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। কলেজের মেয়েগুলো টিপ্পনী ও কাটে। ওর কানে আসে, “ন্যাকা মেয়ে, কিছুই যেন বোঝেনা, বাড়ি থেকে প্রস্তুত হয়ে কেন বেরোয় নি, এইটুকু লজ্জা তো ওর অবশ্যই প্রাপ্য, বেশ হয়েছে।” মল্লিকা বুঝতে পারে না কেন ওর লজ্জা পাওয়া উচিত। ও অনুভব করে ক্রমশ পিছনটা বেশি করে ভিজে যাচ্ছে, একেই তো জীবনে প্রথম শাড়ি পড়ে বাইরে বেরোনো, সেটাই তো ঠিকমতো সামলাতে পারছে না। তারপর কি এমন ঘটলো যাতে ওকে নিয়ে এমন বিদ্রুপ চলছে, ও আর নিতে পারে না, হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এ সময় উল্টো দিকে সিটে বসা এক মেয়ে অনেকক্ষণ ধরেই পত্রিকা পড়ছিল, বছর পঁচিশ হবে। ওর কানেও হাসি-ঠাট্টা শব্দ এসেছে কিন্তু আমল দেয়নি, সামনে দাঁড়ানো মল্লিকার শাড়ির পিছনটা ভেজা। ইমনের বুঝতে অসুবিধা হয় না, কি ঘটেছে, ও আড়চোখে তাকিয়ে দেখে ওরা এখনো হাসাহাসি করছে। আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে ওকে নিয়ে কথা বলছে। হঠাৎ ইমন এর একটু রাগ হলো, তো নিজের গা থেকে জ্যাকেট খুলে মল্লিকার হাতে দিয়ে বলল “বোন, এই জ্যাকেট দিয়ে তুমি শাড়ির পিছনটা ঢেকে নাও, ওটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে, ভয় পেয়ো না এটা এই বয়সে খুব স্বাভাবিক।” এবার মল্লিকা বুঝতে পারল কিন্তু জীবনে এই প্রথম হলেও তৈরি ছিল না, ও জ্যাকেটটা দিয়ে পিছনটা ঢেকে নিল, ইমন ট্রেনের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কলেজের মেয়েগুলোকে বলে, কোথায় ওকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলা উচিত, উল্টে পড়ে পরিস্থিতি নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছো, টিপ্পনী ও করছো, সত্যি মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু, এইটুকু বাচ্চা মেয়ে আপনাদের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে এটুকু কি পেতে পারে না, এগুলো করার আগে এরপর থেকে ভাববেন, এই আশা রাখছি” বলে মল্লিকার দিকে ঘুরে বলে, “আমি একটা কারখানার শ্রমিক, রোজই এই ট্রেনে কারখানায় যাই, যদি সম্ভব হয় এই জ্যাকেটটা ফেরত দিয়ে যেও।” মল্লিকা ইমনকে নিচু হয়ে প্রণাম করতে গেলে ইমন প্রতি মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করে। তখন মল্লিকার চোখে জল চলে আসে। ইমনকে বলল, “আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আপনার মত উঁচু মানুষকে ছোট করবো না। সারা জীবন আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।