• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক বড় গল্পে গৌতম বাড়ই (পর্ব – ১১)

স্মৃতিকথার ঝিকিমিকিরা

সেসময় চৈত্র বৈশাখের দিকে ধূলি ঝড়ের কথা খুব মনে পড়ে। আটের দশকের গোড়ার কথা বলছি। মহানন্দার পাড়ে এই যে লাখো- লাখো লোকের বসতি, তখন ছিল ফাঁকা। পাহাড়ি নদী, বালির চর আর নুড়ি পাথরের অভাব নেই। দুপুর নাগাদ সেই ধূলোর ঝড়ে বাড়ির জানালা দরজা, রাস্তাঘাট সব ঢেকে যেত। মাথাভর্তি বালি। কেউ পারতপক্ষে ঐ সময়টায় বেরোতেন না। এ চেনা ছবি প্রতিবছর যেন আবার ফিরে আসত। আমাদের চোখে পড়ত বালির দানা। জলের ঝাপটা দিতাম। স্কুল থেকে বেরিয়ে এলেও অনেক কসরৎ করে, সোজা উল্টো করে বাড়ি ফিরতাম। তারপর কবে হু হু করে লোক বেড়ে গিয়ে কেমন করে জানিনা কবে সেই ধুলো ওড়ানো ঝড় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমরাও যে বড় হয়ে উঠছি, সেটাও টের পাইনি। আজ ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে ভাবি তোমাদের মতন এই ছোট্টরা ঘরে নিজেদের বন্দী করে রাখো কিভাবে? প্রকৃতি যেন আরও কঠোর ভাবে আমাদের বন্দী করে রাখবার সেই শাস্তি দিল।

(শহরের একটু পাশেই। স্বাস্থ্যের সন্ধানে। ছবি পাপুন ভট্টাচার্য্যের সৌজন্যে।)
আমাদের রেডিওতে খেলা শোনা, গান শোনা। রোববার করে হত শিশুমহল। ছড়ার গান। “বাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস বাপুরে? ” এখন এই বয়সে সাপ বা সরীসৃপ দেখলে কেমন যেন সিড়সিড়ানি হয়, সত্যি বলছি আমরা ঐ বয়সে হেলা সাপ বা ঘেন্টিসাপ হাত দিয়ে ধরতে পারতাম। ভয়ডর ছিলনা বা থাকলেও অনেক কম। দুষ্টুমির কথা এই বয়সে এসে একটু না বললে স্মৃতিকথার ঝিকিমিকি জ্বলবে কেন? একটু বলব। তোমরা শুনলেও ঐ রকম বাঁদরামো আর দুষ্টুমি এখন করতে পারবে না জানি। কারণ তোমাদের বাবা আর মায়েরাও সেভাবে দুষ্টুমি করতে পারেনি বা করলেও তা খুব অল্প। আমাদের বর্ষায় জলে ভিজে কাঁদা মেখে ফুটবল খেলা ছিল খুব আনন্দের। তবে শরীর যে ঐ ভাবে বৃষ্টিতেই ভিজলেই খারাপ হত তা কিন্তু নয়। গুরুজনদের বকাঝকা খেতাম তারপর আবার খেলতাম। তখন রেওয়াজ ছিল পাড়ায় পাড়ায় আন্ডার হাইটের খেলার, খুব খেলেছি ফুটবল সেই সময় আমরা। সে ছিল ভীষণ আনন্দের। হাত ভেঙ্গেছে। পা মচকেছে, আবার চুন হলুদ লাগিয়ে খেলা। এখন এত খেলা! এত খেলা! মাঠের খেলা কোথায়? কিছু আসে আর কিছু হারাই আমরা সবসময়।

(পথের পাশে বনফুল। নাম যেন কী? ছবি: গৌতম বাড়ই)
ছিপ বানালাম মহাবীরস্থানের নেতাজী মার্কেটের ভেতরে একটি দোকান ছিল সব সরঞ্জাম বেচত মাছ ধরবার। সে ছিপ ছাদের কোণে লুকিয়ে রাখলাম। রোববারে তিনবাতি মোড় পেরিয়ে ফুলবাড়ির দিকে গেলাম মাছ ধরতে। এখন যেখানে উত্তরকন্যা ভবন হয়েছে, বিস্তীর্ণ মাঠঘাট আর জলাজমি ডোবা ছিল তখন। আমরা একটা ডোবার ধারে বসলাম। ছিপে চার দিয়ে ফাৎনার দিকে তাকিয়ে আছি। শুনেছি এখানে সিঙ, মাগুর, কৈ মাছ পাওয়া যায়। দেখলাম ডোবার একদম ধারে আমাদের থেকে কুড়ি পঁচিশ মিটার দূরে দুজন লোক ওরকম ফাৎনা পেতে বসে আছে। আমাদের এক বন্ধু ছিল একসাথে বেরোলেই নিজেকে সপ্রতিভ( স্মার্ট) দেখানোর জন্য অদ্ভুত সব কাণ্ড করে বসত। ঐ দুজন লোককে দেখেই চেঁচিয়ে বলল— দাদা, এইখানে কী কী মাছ পাওয়া যায়? কিছু পেয়েছেন?
এই না শুনে যে গামছা দিয়ে মাথা ঢেকেছিল লোকটি তিনি মুখের একটি পাশ ঢেকে দিলেন গামছা দিয়ে ভাল করে। আর কথার কোন উত্তর দিলেন না। যাক তখন ঐ ঝোপঝাড়ে সবুজ মাঠেঘাটে মাছ ধরার চেয়েও আমার কাছে উপরি পাওনা ছিল প্রকৃতি। দূরে এনজেপির রেলপথে ট্রেন যাচ্ছে, বেশিরভাগ মালগাড়ি কখনও প্যাসেঞ্জার ট্রেন। আপ এবং ডাউন লাইনে। তারপরে নীলপাহাড় উত্তরদিক জুড়ে। আমি চিপের সাথে প্রকৃতির ও স্বাদ নিচ্ছিলাম। কী সুন্দর এক মেঠো গন্ধ। জল সূর্যের তাপে বাষ্প হচ্ছে। সে বাষ্পীয়গন্ধ নাকে লাগছে। তোমরাও এরকম ফাঁকা বিস্তীর্ণ মাঠঘাট পেলে বসে দেখো আমাদের প্রকৃতিকে। ভালো লাগবেই। সেই বন্ধুর নাম বলছি না, তবে আর যে কাণ্ডটি সেদিন করে বসল, এখনও ভাবতে বসলে হাসি মনে মনে।

(ছবি: গৌতম বাড়ই)
সে চেঁচিয়ে ঐ লোকটিকে বলল— আরে দাদা কানে কালা নাকি? বলছি মাছটাছ আছে এই এঁদো পুকুরে?
এবার শুধু উত্তর নয়, গর্জন শোনা গেল ডোবার ধার থেকে।
— আরে এ ছোকরা এখানে শুধু মাছ নয়, তোর বাপও আছে। দেখ তাকিয়ে। বহুত সাহস বেড়েছে।
আরে একী! দুজন লোকের একজন সেই বন্ধুর বাবা আর মাণিককাকু। আমরা হতভম্ব হয়ে ছিপটিপ ফেলে লাগালাম দৌড়। দেখি আমাদের পেছনে তেনারা দৌড়চ্ছেন। আমাদের সাথে দৌড়ে পারবেন না জানি। তবুও প্রাণপনে ছুটছি।

(ছবি: গৌতম বাড়ই)
পেছন থেকে শোনা যাচ্ছে— তোদের মাছধরা বের করছি। বেশি পেকেছিস। দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি।এইসব কথা। আমরা যারপর নাই ছুটে ওনাদের সাথে দূরত্ব তৈরী করছি।

এরপর আবার
সামনের শনিবার—–

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।