গদ্যের পোডিয়ামে দীপা সরকার

স্মৃতির জানালায় একদিন
সেই দিনটা আজও মনে আছে। স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটি পড়েছে, আর বাবা হঠাৎ বললেন, “চলো, একসাথে মামার বাড়ি যাই – ট্রেনে!” ছোটবেলার মন আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল । কারণ ট্রেনে চড়া মানেই নতুন এক রোমাঞ্চ, নতুন কিছু দেখার অপেক্ষা, ঠিক একটা নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের মত।
স্টেশনটা ছিল গরমে হাঁসফাঁস করা এক দুপুরে – তবু মানুষের কোলাহলে প্রাণবন্ত। পিঠে ব্যাগ, হাতে বোতল, আর কাঁধে বাবার হাত। মার এর কোলে ভাই।ট্রেন সোদপুর স্টেশনে এসে থামতেই হুড়মুড় করে মানুষ উঠছে-নামছে, যেন একটা জীবন্ত নদীর মতো বয়ে চলেছে। আর আমরা ছোট মাছ এখনি ওই নদীতে ভেসে যাব।
জানালার ধারে আমার সিট, আর সঙ্গে একটা ঠান্ডা বাতাসের দোল। ট্রেন ছাড়তেই বাইরে সবকিছু পিছিয়ে যেতে লাগল – বাড়ি, গাছ, দোকান, মানুষ। মনে হচ্ছিল, আমি যেন সময়ের পিঠে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
বাইরে মাঠ, খেত, নদী , পুকুর, আকাশ– সব মিলিয়ে যেন রঙিন জলরঙের ছবি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশনে থেমে যেত ট্রেন, চা-ওয়ালা ডাকত “চা-চা-চা”, আর আমরা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নতুন জগৎটা গিলে খেতাম চোখে।
পাশের সিটে থাকা এক কাকু গল্প করছিলেন তার ছোটবেলার ট্রেন যাত্রা নিয়ে। আমি মন দিয়ে শুনছিলাম সেই অমনিবাস, কারণ তাতে ছিল সেই অচেনা সময়ের গন্ধ – চিঠির যুগ, হারিয়ে যাওয়া মহাভারত আর কুরুক্ষেত্রের গল্প, আর পুরনো স্মৃতির ধুলো।
এই যাত্রা ছিল ছোট, কিন্তু মনে রেখে দেওয়ার মতো বড়। ট্রেন কেবল এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভার বহন করেনা, মাঝপথে আমাদের ভরিয়ে দেয় গল্প, মানুষ আর অনুভূতির রঙে।
আজও ট্রেনের বাঁশির শব্দ শুনলে মনটা কেমন যেন আইসক্রিম এর মত হয়ে যায়। জানালার ধারে বসে থাকা ছোট আমি এখনো আমার মধ্যে কোথাও বেঁচে আছে – সময় আর স্মৃতির ট্রেনে চেপে।