সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবদাস কুণ্ডু (পর্ব – ১৪)

লড়াইয়ের মিছিল

পর্ব – ১৪

নতুন সরকার এসে হাটের নিয়ম কানুন পাল্টে দিয়েছে। এখন রাত দুটো নয় ।হাট শুরু হয় ভোর চারটে থেকে। শেষ হয় সকাল আটটায়। কেউ রাস্তায় দোকান লাগাতে পারবে না। আটটা দশ হয়ে গেলে দোকান না তুললে পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে মাল। যেমন আজ নিয়ে গেছে সুশীলের মাল।
দুশো টাকা দিল সে। চামচে ছেলেটি বলল, ‘দুশোতে হবে না। তিনশো দিতে হবে। ‘
‘আজ তেমন বেচাকেনা হয় নি। ‘
‘মিথ্যে কথা রাখুন।
‘মিথ্যে না। বিশ্বাস করুন সত্যি। করোনার ভয়ে এখনও তেমন পায়কাররা আসছে না। হাট জমেনি।
‘আড়াইশো দিন’
‘দুশো রাখুন না। ভুল হয়ে গেছে। আর কোনদিন হবে না। ‘
কি করবে? আড়াইশো দিয়ে মাল ছাড়িয়ে ভ্যানে চেপে যখন বাড়ি ফিরলো সুশীল, তখন দুটো বেজে গেছে।
হাওড়া হাটও খুলেছে অনেক আন্দোলন করার পর। তাও পুরো হাট নয়। একটা দিক খুলেছে। পুরো খুলবে না সরকার। তাহলে করোনা ছড়িয়ে পড়বে। টাইমও কমিয়ে দিয়েছে। সে এখন হাওড়া হাটে যাচ্ছে না। করোনা সব গন্ডগোল করে দিয়েছে। ছোট ছোট ব্যবসায়ী সব মরে গেছে। পূঁজি ভেঙে খেয়ে এখন নি:স্ব। কেউ কেউ নানা কাজে ঢুকে পড়েছে। কেউ সবজি, কেউ ফল, কেউ মাছ, কেউ ফুল বেচতে নেমে পড়েছে। সে তার পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে কখনো এমন দেখেনি। জীবনে দারিদ্র্য দেখেছে অনেক। লড়াই করেছে অক্লান্ত। আজ সে কোটি টাকার মালিক। সোদপুরে বাড়ি। কলকাতা বাড়ি ।নিউটনে জমি। বিধাননগরে ফ্ল্যাট। এফ ডি। আরো কতো কিছু। বিয়ে করেছে। দুই মেয়ে। বড় মেয়ে বি. এস. সি. পড়ছে। ছোট ক্লাশ সিক্স। বাবা এখন ঘরে থাকেন। কোন কাজ করেন না। দরকার নেই। তিনি তো ওপার বাংলা থেকে এসে এই বাংলায় কম লড়াই করেনি। এখন অবসর। এক বছর আগে হঠাৎ বুকে ব্যথা হয়। নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। একটা ভালম্ব খারাপ। পাল্টে দিল। তিন লাখ খরচ হলো। হোক খরচ। মানুষ টা তো ফিরে এসেছে। এটাই বড় পাওনা।বাবা আছে বলে মনে একটা বল থাকে। কিছুই করতে পারবে না, সে জানে তবু একটা ছায়া। একটা আশ্রয় ।বট গাছের মতো। কিন্তু বাবার একটা স্বভাব খারাপ। ডাক্তার না করেছেন, তবু তিনি ধূমপান করে চলেছেন। তাকে দেখলে অবশ্য লুকায়।। এই বয়ষে এসে একটা মানুষ ডাক্তারের কথা উপেক্ষা করে কেন? তবে কি আশি পার করে আর বাঁচতে চান না? নাকি নেশাটা ছাড়া যাচ্ছে না। কিন্তু সে দেখেছে, যখন কোচিং করত যেত শ্যামবাজার। কোচিংর মালিক দিপু দাশ সকাল থেকে রাত অবধি সিগারেট খেতেন। সকালে একটা কাঠি দিয়ে যে আগুন ধরালেন, সেই আগুন থেকে পরের সিগারেট। সেই আগুন থেকে আবার সিগারেট। মানে চেন স্মোকার ছিলেন। একদিন দেখি মুখে সিগারেট নেই। সে জিগ্যেস করেছি, ‘কি ব্যাপার সিগারেট খাচ্ছেন না? মানুষ টা জবাব দিয়ে ছিল, ‘না’
‘ছেড়ে দিলেন কেন?
‘ব্যাথা হচ্ছিল বুকে।
আপনার বহু বছরের নেশা। ছাড়লেন কি করে?
মানুষটার জবাব শুনে সেদিন সে থম দিয়ে বসে ছিল অনেকখন। বলে কি লোকটা? যেভাবে মানুষ জামাকাপড় ছাড়ে সেভাবে তিনি নেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
‘এভাবে নেশা ছেড়ে দিলেন? এভাবে হয় নাকি?
‘সুশীল তোমাকে একটা কথা বলি তুমি যদি মনে করো আমি খাবো না। কেউ তোমাকে জোর করে খাওয়াতে পারবে না। মনের জোর চাই এটাই আমি করবো।
‘কিন্তু কতো লোক নেশা ছেড়ে দেয়। কিছু দিন পর আবার ধরে।
‘আমি ধরবো না’
‘পারবেন তো? ।
‘দেখ সুশীল তোমাকে একটা কথা বলি, এটা চিরকাল মনে রাখবে।
‘কি কথা শুনি।
‘তুমি যদি মনে করো আমি সম্রাট হবো তবে তুমি একদিন ঠিক সম্রাট হবেই হবে। ‘
একটা দামী কথা আও সে বুকের ভিতর মোহরের মতো জমা করে রেখেছে। দীপুদার সেদিনের সেই কথা তাকে লড়াইতে কতো শক্তি দিয়েছে তা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। যখনই লড়াইতে হেরে যেত তখন সংগে সংগে মন্ত্র জপের মতো দীপুদার কথাটা স্মরণ করতো সে। কিন্তু বাবা কেন ছাড়তে পারছে না? সে একদিন বাবাকে বুঝিয়েছে। কিছু দিন বন্ধ রেখেছিল, আবার ধরেছে। সে কি বলবে? তার তো কোনদিন একবারের জন্য ইচ্ছে হয়নি একটা টান দিয়ে দেখি তো কেমন লাগে? মাকে দিয়ে বলেছে। তবু কিছু হয় নি। মা অশান্তি করলে বলে,আমি তো খাইনি তো।
মা বলে, ‘তোমার মুখ দিয়ে গন্ধ বের হচ্ছে আর তুমি বলছো খাও নি। নাতি নাতনি হয়ে গেছে তবু মিথ্যে কথা বলছো।
দেখ বেশি ভ্যান তাড়া করো না তো। যাও শুয়ে পড়।সে বুঝছে, এক একজন মানুষ আছে যারা ডাক্তারের কথা মানে না। ডাক্তার বলেছেন এটা করবেন না। ওটা করবেন না। তারা এসব পালন করে না। তারা মনে করে জীবন আমার। আমার যা ভালো লাগে আমি তাই করবো। ডাক্তার তুমি বলার কে?
সুশীল বুঝেছে, বাবা কোনদিন শুনবে না। আসলে বাবা নয়। জীবন কারো হুকুম পালন করে না। সে তার নিজস্ব ছন্দে চলে। সেই চলায় তার আনন্দ।
বাবা বাকি জীবনটা সেই আনন্দ নিয়ে থাক।
সুশীল খেয়ে দেয় শুয়ে পড়ল।এক ঘন্টা পর ধরমর করে উঠে বসল। কি ব্যাপার? এমন স্বপ্ন দেখলো কেন সে?
বাবা মরে গেছে।  শ্মশানে সে চলেছে।  ঘর থেকে ডাক দিল, ‘বাবা ও বাবা
‘কি হয়েছে?
এদিকে এসো
পরেশ বাবু এঘরে এলে সে বলে, ‘এখানে বসো বাবা।
কি হয়েছে তোর বলতো?
আমাকে একটু ছেলেবেলার মতো আদর করো।
পরেশবাবু অবাক। বলে কি ছেলেটা? । কোনদিন তো এমন কথা বলে নি। বৌমাকে নিয়ে ছেলেটা অশান্তির মধ্যে আছে। কেন বৌমা এমন করছে কে জানে? দিব্যি তো সংসার করছিল। দুবছর ধরে কি হলো? কে জানে। আমার ছেলেটাকে সন্দেহ করে? কেন করে? এমনি এমনি সন্দেহ করে বসলো। এই তো পঞ্চাশ বছরের বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছি। স্ত্রী কোনদিন একথা বলতে পারবে?
কি হলো বাবা? ছেলেবেলার মতো মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না।
সে দিচ্ছি। কিন্তু তোর হয়েছে কি আজ?
‘তোমার বউমাকে বড় চিন্তা হয়।
‘সে আমাদেরও হয়। একটা কথা বলবি?
‘ বলো তুমি?
‘বউমা যে সন্দেহ করছে, সেটা কি সত্যি?
সুশীল থম দিয়ে থাকে। বাবা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ভালো লাগছে। কিন্তু বাবার প্রশ্নের কি জবাব দেওয়া যায়?
‘আমাকে বলতে অসুবিধা থাকলে মাকে বলিস।‘
‘বাবা তুমি কি বিশ্বাস করো বউমার কথা?’
‘অবিশ্বাস করি না। ঘন ঘন এখন বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। দু চার বছরও দাম্পত্য সম্পর্ক টিকছে না। রোজ খবরের কাগজে দেখছি। কিন্তু কেন? ‘
‘ তোমার কি মনে হয় বাবা? ‘
‘কোথায়ও একটা পতন শুরু হয়েছে।‘
‘মানুষ টের পাচ্ছে না? ‘
‘পতনের যে কোন শব্দ নেই খোকা। ‘
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।