সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৪)
শহরতলির ইতিকথা
হৈমবতীর মুখের তোড় বেড়েই চলেছে;প্রায়ই যদি কথা প্রসঙ্গে,"তুমি এলে,আর আমার শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি ঘুঁচে গেল" শুনতে হয়,তবে নতুন বৌ'র মানসিক কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে,তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। নতুন বৌ'র চোখের জল, না ঝরাতে পারলে বোধ হয়,হৈমবতীর মনে শান্তি আসছে না।এ এক অদ্ভুত বিকার-গ্রস্ত,অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব;রাজীবের কানেও সে কথা গেছে,সে এ মিথ্যার প্রতিবাদও করেছে। ওদের দেশের সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য, হৈমবতী যে আদাজল খেয়ে লেগেছিল, হাজরামশাই কে উঠতে বসতে খোঁটা দিত, উত্যক্ত করতো, দেশের সম্পত্তি বিক্রির অন্যতম কারিগর যে হৈমবতী নিজে,সে কথা রাজীব স্পষ্ট করে,সকলের সামনে ব্যক্ত করেছে, আর হৈমবতীর রোষানলে পড়েছে। তা হোক, কতক্ষণ আর সে বাড়িতে থাকে! অন্যসময় যে কী হয়, তা সর্বক্ষণ যারা থাকে, তারাই তা প্রকৃত বলতে পারবে।
হাজরামশাই, কারখানার কাজ না থাকলে, বাইরের খোলা বারান্দার গোল পিলারে মাথা ঠেকিয়ে বসে চা খেতে খেতে বসুমতী খবরের কাগজ পড়েন।
তিনি,এ মিথ্যার কোনো প্রতিবাদ করেছেন বলে ,রাজীবের জানা নেই। কাছেই তো বাপের বাড়ি,তাই ছুটি-ছাটায় বাপের বাড়ি গেলে, নতুন বৌ আর আসতে চায় না; বাপের বাড়ির লোকেদের ফোড়ন থাকাও কোনো অস্বাভাবিক নয়।
সজীবও ,শ্বশুর বাড়ি থেকেই অনেক সময় কারখানার কাজে যায়। সংসারে,অভাব প্রকট হয়ে উঠছে;হাজরা,সজীবকে সংসারের জন্য টাকা বেশি করে দেবার কথা বলছে;আরে টাকা কি গাছে ফলে! কারখানার কাজের তো একটা মাত্রা আছে,রোজগারের তো সীমা আছে; গোদের উপর বিষফোড়া, লোন কাটা চলছে;এদিকে ওরও হাতখরচা বেড়েছে,নতুন বিয়ে হয়েছে, না! সংসারের খরচ বেড়েছে,খাবারের মুখ বেড়েছে,অতএব সংসার চালানোতে টাকার পরিমান বৃদ্ধি হওয়াই তো স্বাভাবিক:অতএব সজীবের সঙ্গেও শুরু হলো মনোমালিন্য,এর যে কী পরিণতি, রাজীবের কাছে তা স্পষ্ট। এদিকে বৌমারও আঁতুড় ঘরে ঢোকার সময় হয়ে আসছে,সজীবের এ সংসারের প্রতি টান কমছে,প্রায়ই শ্বশুর বাড়ি চলে যায়,ওখান থেকেই কাজে যাবার ক্রম বৃদ্ধি পেল।
রাজীবের আইএ'র(কমার্স) ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রাজীব, সকাল- বিকেলে ট্যুইশান করে,হাতে টাকা জমা করে একটা সাইকেল কিনবে, যাতায়াতের সময় বাঁচবে,ও ঐ সময়টায় আর একটা ট্যুইশান করতে পারবে।বৌদির একগাছা চুড়ি বন্ধক দেওয়ার টাকা ও জমানো টাকায়,সে চন্দননগর থেকে রয়ালহুড নামে এক অজানা ব্রাণ্ডের সাইকেল কিনলো;এখন যাতায়াতের সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ায়, সে সকালে আর একটা ট্যুইশান ধরেছে; মাস দুয়েকের মধ্যেই, সে বৌদির চুড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে,নিজের কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেনি।সংসারের অশান্তির চোটে,এ বাড়ির উপর দিয়ে কাক-পক্ষীও যেতে সঙ্কোচ বোধ করে।
রাজীব ,কাকা হয়েছে; সজীব ,কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছে;নতুন -বৌ'র প্রসব,বাপের বাড়িতেই হয়েছে,সজীবের শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার ক্রমও বেড়েছে।নিজেদের বাড়িতে তো এণ্ড-গেণ্ডির নাক দিয়ে এখনও পোঁটা ঝড়ছে।হাজরা-দম্পতির কাছে,সজীবের এ প্রবনতা মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়,সুতরাং সংসার- যুদ্ধের আর একটা ফ্রন্ট খুলে গেল।
আইএ পরীক্ষার ফল বেড়িয়েছে।অঞ্চলের দু'জন প্রথম বিভাগে উর্ত্তীর্ণ হয়েছে;রাজীব, আর রাজীবদের এক প্রতিবেশীর মেয়ে,সে হুগলির মহসসীন কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়েছে। এরপর থেকে গঙ্গার পশ্চিম পারের প্রায় সব কলেজই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যাবে।
রাজীব, ঋষিবঙ্কিম চন্দ্র কলেজের নৈশ বিভাগে বি-কম কোর্সে ভর্তি হল।
সন্ধেবেলার ট্যুইশান বন্ধ হয়ে গেল।আবার জীবনযাত্রার রুটিনটাও গেল পাল্টে ।সান্ধ্যবিভাগে যারা পড়াশোনা করে, তারা প্রায় সবাই চাকুরিজীবী;আবার নৈহাটি যাবার জন্য হুগলীঘাট স্টেশন থেকে ইএমউ কোচ ধরে নৈহাটি যাওয়া,কারন,ওদের অঞ্চল থেকে বিকেল বেলায় যাওয়া বা রাত নটা-সাড়ে নটায় ফেরার কোনো ট্রেনের ব্যবস্থা নেই;অগত্যা সাইকেল করে হুগলীঘাট যাওয়া,আবার রাতে,ঐ হুগলীঘাট স্টেশন থেকে ওদের অঞ্চলে সাইকেলে চেপে ফেরা,কষ্টসাধ্য বই কি! বিশেষ করে,শীতের রাতে রাস্তা থাকে কুয়াশায় ঢাকা ,নির্জন রাস্তায় গা ছমছম এমনিই করে,সবচেয়ে ভয় সাইকেল ছিনতাই করে নেবার, কারন,রাস্তা থাকে শুনসান,দুদিকে কেবল নিঃস্তব্ধ, ঘন আমবাগান। ব্যাণ্ডেল চার্চের কাছ পর্যন্ত সঙ্গী থাকে,তারপর কেবল সে একা,দুরুদুরু বুকে কেওটা ফাঁড়ি পর্যন্ত সাইকেল চালানো,এরপর অবশ্য আছে রাস্তার দুদিকে বাড়ি,বসতি,আরো বাড়ির দিকে এলে, চোখে পড়ে ডানলপ কারখানার সিপ্টিংএ আসা-যাওয়ার শ্রমিকদের ব্যস্ততার ছবি।
(চলবে)
0 Comments.