- 48
- 0
আরাকানবাসীর প্রবল আক্রমণে একরকম দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন মহারাজ লক্ষণমানিক্য। তারপরে কোন উপায় না দেখে তিনি খিজিরপুরের ইশা খাঁয়ের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। আসলে বারভূঁইয়ার মধ্যে ইশা খাঁকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে ধরা হয়। কারণ সব ভূঁইয়াদের মধ্যে তাঁর প্রতাপ ছিল চোখে পড়বার মত। তার পিছনে অন্য একটি কারণও ছিল বটে। দিল্লি থেকে বাদশার ফরমান নিয়ে মানসিংহ যখন খিজিরপুর আক্রমণ করেন, তখন ঈশা খাঁয়ের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পরে ইশা খাঁ পরাজিত হলেও মানসিংহ তাঁর বীরত্বে অভিভূত হয়ে যান। আর সেই কারণে ইশা খাঁকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। দিল্লিতে বাদশাহের দরবারে ঈশা খাঁয়ের প্রবল বীরত্বের কথা তিনি জানান। আর তখন আকবর বাদশা সন্তুষ্ট হয়ে ইশা খাঁকে মুক্তি প্রদান করেন এবং সঙ্গে সোনারগাঁয়ের শাসনভার অর্পণ করেন। সেই থেকে ঈশা খাঁয়ের সঙ্গে আকবর বাদশার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। আর রাজনৈতিক এই জায়গাটিতেই ইশা খাঁ কিছুটা বাধ্য ছিলেন বাদশা আকবরের কথামত চলতে। যা অন্যান্য ভূঁইয়ারা খুব একটা ভালোভাবে নিতেন না। কিন্তু লক্ষণমানিক্য আর কোনো উপায় না দেখে ইশা খাঁয়ের মাধ্যমে বাদশাহের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ইশা খাঁও যথারীতি আরাকানবাসীর এই দৌরাত্মের কথা বাদশাকে চিঠি লিখে পাঠালেন। বাদশাহ সেই সময় বাংলায় তাঁর সেনাপতিকে যুদ্ধের জন্য পাঠাতে প্রস্তুত করলেন। যদিও বাংলার ভূঁইয়ারা প্রধানত মুঘলদের বিরোধিতাই করে গেছেন আগাগোড়া, কিন্তু তাও মগদের উচ্ছেদ করবার জন্য সকলেই এই যুদ্ধের প্রস্তুতিকে মেনে নিলেন। এবং বাদশাহের বাহিনীকে বাংলা এক রকম স্বাগতই জানালেন। কারণ মগেরা ছিল দস্যু। আর তাদের দস্যুবৃত্তির হাত থেকে কারো নিস্তার ছিল না। সেই সময় ভুলুয়া পরগনায় মগদের একটি কেল্লা ছিল। নাম তার 'সহর কসবা'। মুঘল বাহিনী সেই কেল্লা আক্রমণ করলো। লক্ষণমানিক্য ভুলুয়া থেকে চলে যাওয়ার পর মগ'রা সেই স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেছিল। কারণ ধীরে ধীরে তাদের প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে মুঘল সহায়তা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না বাংলার হাতে। তো সেই যুদ্ধে মুঘল এবং ভূঁইয়াদের যৌথ বাহিনীর কাছে আরাকানরা পরাজয় স্বীকার করল। এই যুদ্ধের পরে লক্ষণমানিক্য আবার ভুলুয়ায় ফিরে এলেন এবং নিজ সিংহাসনে আরোহন করলেন। শোনা যায় লক্ষণমানিক্যের ইষ্টদেবী ছিলেন বারাহী৷ সেই দেবী আজও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত আছেন। পুনরায় রাজ্য ফিরে পাওয়ার পর তিনি সেই দেবীর ধুমধামে পূজা করেন। মহারাজ লক্ষণমাণিক্যের সম্বন্ধে যতই বলা যায় ততই যেন কম পড়ে। আসলে তাঁর বিচক্ষণতা এবং সুরাজকার্য পরিচালনা ছিল চোখে পড়বার মত। তাঁর বংশধরগণ বহু যুগ ধরে ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করে গেছেন। একরকম তিনিই ছিলেন সেই বিশাল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। নিজরাজ্য আবার ফিরে পাওয়ার পর তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থদের নিজের রাজ্যে নিয়ে আসেন এবং তাদের জায়গা জমি প্রদান করেন। পরে সেখানেই এক বিস্তীর্ণ হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। লক্ষণমাণিক্যের মৃত্যু নিয়ে বেশ কয়েক রকমের মতবাদ প্রচলিত আছে। শোনা যায় কোন এক বিবাহ অনুষ্ঠানে তিনি কায়স্থ সমাজপতিদের ভুলুয়াতে আমন্ত্রণ করেন। সেই সময় সকলে এলেও প্রতাপাদিত্যের প্রতি একটু বেশি আতিথ্য প্রদর্শন করেন তিনি। যা চোখে পড়ে বাকলা অধিপতি বীর রামচন্দ্র রায়ের। আসলে তিনি বাংলায় নিজের সাম্রাজ্যকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন। আর সেই কারণে প্রতাপাদিত্যের প্রতি আলাদা সম্মান প্রদর্শনকে তিনি ভালো চোখে নেননি। সেই থেকেই শুরু হয় ভুলুয়ার সঙ্গে বাকলার লড়াই। এরপর রামচন্দ্র হঠাৎ লক্ষণমাণিক্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কতকগুলি যুদ্ধজাহাজ ভুলুয়ায় পাঠিয়ে দেন। এই খবর পেয়ে ভুলুয়ারাজ লক্ষণমাণিক্য রাগে সেই বালক রামচন্দ্রকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু হাতে গোনা সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু রামচন্দ্রের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে বিপদে পড়েন স্বয়ং লক্ষণমাণিক্যই। প্রচলিত আছে এই সময়ে লক্ষণমাণিক্য রামচন্দ্রের হাতে বন্দি হন এবং বাকলা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। যদিও প্রথমেই লক্ষণমাণিক্যকে প্রাণদণ্ড দণ্ডিত না করে কারাবাসে রাখেন রামচন্দ্র রায়। কিন্তু পরে প্রাণদণ্ড দেন এবং বাকলাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও এই মতামতের বিপরীত মতও আছে। কারণ অভিজ্ঞ ও যুদ্ধপারদর্শি লক্ষণমাণিক্য বাকখিল্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করে রামচন্দ্র রায়ের হাতে বন্দি হবেন তা ইতিহাসের কালক্রমে মেনে নেওয়া খুব কঠিন। তাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মত হিসেবে যেটিকে মেনে নেওয়া হয় তা হল মুঘলদের সঙ্গে মগদের লড়াইয়ের সময়ে বীর বাঙালি রাজা লক্ষণমাণিক্য ইহলোক পরিত্যাগ করেন। সেই যুদ্ধে তিনি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন বটে, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তাই মগদের হাতেই তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ঐতিহাসিকভাবে এই মতটিকেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। যদিও এই বিষয়ে কোন প্রামাণ্য দলিল এখনও পর্যন্ত আমি পাইনি। শুধু লক্ষণমাণিক্যের মৃত্যুর ব্যাপারে যে দুটি অভিমত শোনা যায় সেই দুটির উল্লেখ করলাম। কিন্তু বীর রাজা লক্ষণমাণিক্যের বীরত্ব নিয়ে কোন সংশয় নেই। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনই বলে দেয় তাঁর সুশাসন এবং রাজ্য বিস্তারের কথা। বাকি কথা ইতিহাসের খাতায় তোলা থাকবে। আর তোলা থাকবে তাঁর ভুলুয়া অর্থাৎ অধুনা নোয়াখালির রঙিন ইতিহাসটুকু।
0 Comments.