Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব - ১০)

maro news
কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব - ১০)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ

'হিন্দু-সমাজ-সমন্বয়’সঙ্কল্প আচার্যদেবের অন্তরে জাগ্রত হওয়ার পর থেকে আহার নিদ্রা ভুলে ধর্মের ভিত্তিতে শক্তিশালী হিন্দু জাতি গঠনের জন্য প্রচারের পর প্রচারকার্য নিয়ে দেশময় ছুটে বেড়িয়েছেন।  মূলত ১৯৩৪খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ এবং বাংলার বাইরেও হিন্দু সমাজ-সমন্বয় আন্দোলনের এক জমি তৈরি করেন।  পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গা যেমন রাজশাহী, পাবনা, ফেনী, চট্টগ্রাম,কুমিল্লা,দেবপাড়া,কল্যাণদি,চৌমোহনী,নোয়াখালি বাবুরহাট, চাঁদপুরে আচার্যদেব  নিজে উপস্থিত থেকে প্রচার, ধর্মসভা এবং শতাধিক মিলন মন্দির তৈরি করেন। দিন ও রাত্রির যেকোনো সময় আচার্যদেবের কান্ডারী যেখানে ভিড়ত সেখানেই মহোৎসব লেগে যেত।

এই সময় আচার্যদেব বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে হিন্দু সম্মেলন করলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে বালিগঞ্জে হিন্দু সম্মেলনের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সেদিন শ্যামাপ্রসাদের গলায় মালা পরিয়ে বাঙালি হিন্দুর সামনে দাঁড়ানোর লোক ঠিক করে দিলেন। আচার্যদেব বললেন : “হিন্দু জাতি শান্তিপ্রিয়, উদার। নিরর্থক কারো ধন,সম্মান,স্বার্থে আঘাত দেওয়া তার স্বভাব নয়। অপরকে বঞ্চিত করে অন্যায় অধিকার সে চায় না। কিন্তু, অন্যায়-অত্যাচারও সে সহ্য করতে প্রস্তুত নয়। আত্মরক্ষার জন্য -আজ আমি ব্যাপকভাবে গ্রামে গ্রামে হিন্দু রক্ষিদল- গঠন কর্ম্ম- পদ্ধতির প্রবর্ত্তন - চাই। কার্য্য কিয়ৎ পরিমাণে অগ্রসর হয়েছে; এখন চাই-হিন্দু নেতৃবৃন্দ তথা হিন্দু জনসাধারণের পৃষ্ঠপোষকতা। সিদ্ধি সুনিশ্চিত।”

 ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর আচার্যদেবের নির্দেশে সঙ্ঘের গয়া সেবাশ্রমে বিহার হিন্দু সম্মেলন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল। এই সম্মেলনে হিন্দু জাতির দুর্দশার মূল কারণ বিশ্লেষণ এবং হিন্দুসংগঠনের উপায় সম্বন্ধে প্রস্তাবাদিও গৃহীত হল। স্বয়ং আচার্যদেব নিজে উপস্থিত থেকে যাবতীয় কর্মব্যবস্থা সুসম্পন্ন করালেন। সম্মেলনের প্রারম্ভে উদ্বোধন ভাষণে তিনি বললেন : “হিন্দু সমাজ ও হিন্দুজাতির যাবতীয় দুর্দশা ও অধঃপতনের মূল কারণ -হিন্দুধর্ম্মের গ্লানি। হিন্দুধর্ম্মের গ্লানির মূলে-হিন্দুধর্ম্মের আদর্শ ও সাধনা সম্বন্ধে অজ্ঞতা, বিস্মৃতি ও উপেক্ষা। স্বীয় ধর্ম্ম-সংস্কৃতি সম্বন্ধে অজ্ঞতা, বিস্মৃতি উপেক্ষার মূলে-হিন্দুধর্ম্মের যথোচিত প্রণালীবদ্ধ প্রচারের অভাব। ভারতে মহাজাতি গঠনের সমস্যার সমাধানকল্পে প্রয়োজন -হিন্দু জাতিগঠন। আর হিন্দুজাতিগঠনের প্রথম পর্ব্বেই চাই- হিন্দুধর্ম্মের প্রণালীবদ্ধ প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা। সঙ্ঘের পক্ষ হতে দশটি ধর্ম্মপ্রচারক সন্ন্যাসীদল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রচারকার্য্যে নিযুক্ত আছে। দেশের অর্থ ও প্রতিপত্তিশালী-বিশেষভাবে মঠধারী মণ্ডলেশ্বর ও মোহন্তগণের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করি।”

 ৭,৮,৯ অক্টোবর কাশীতীর্থ সেবাশ্রমে, ১৫ই অক্টোবর বর্তমান উত্তরপ্রদেশে পরপর চারটি হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। আচার্যদেব তাঁর বক্তৃতায় বললেন : “হিন্দুধর্ম্মের উদার ও শক্তিপ্রদ আদর্শ ও অনুষ্ঠানাদির প্রচারাভাবেই হিন্দুজাতি আজ দুর্গত, লাঞ্ছিত,ভেদ-বিবাদে দুর্ব্বল ও আত্মরক্ষায় অক্ষম। ধর্ম্মের যথার্থ আদর্শের ভিত্তিতেই  হিন্দুজাতির পুনর্গঠন আবশ্যক। হিন্দুধর্ম্মের আদর্শ ও আচরণের মধ্যে আদ্যন্ত তেজস্বিতা বীর্য্যবত্তা- আত্মরক্ষা, আত্মবিস্তার ও জাতীয়তার চেতনায় পরিপূর্ণ। ক্লৈব্য-দৌর্ব্বল্যে মুহ্যমান হিন্দু জাতিকে আজ সেই ধর্ম্ম ও জাতীয়তার অমর সিদ্ধান্ত প্রচারপূর্ব্বক দুর্জ্জয় প্রেরণা সঞ্চার আবশ্যক।”

 ৩০ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে আবার হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। আচার্যদেব তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বললেন : “হিন্দু মহাশক্তির পূজারী, মহাবীর্য্যের সাধক। হিন্দুর ধর্ম্মসাধনার উদ্দেশ্য -মানবাত্মায় নিহিত অনন্ত শক্তির উন্মেষ, বিকাশ, প্রকাশ। যে ধর্ম্ম- মানুষকে শক্তিমান করে না, হিন্দুর মতে তা’ অধর্ম; যে সাধনা সাধককে বীর্য্যবান করে তোলে না, হিন্দুর মতে - তা’ ভণ্ডামি -আত্মপ্রতারণা। ভ্রান্ত তারা, যাদের ধারণা -হিন্দুর ধর্ম্ম- হিন্দুকে ক্লীব,কাপুরুষ, দুর্ব্বল করেছে। হিন্দুধর্ম্মেরর বাণী- ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ।’ হিন্দুর দেবতা অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত, বীর্য্যঘনমূর্ত্তি। হিন্দুধর্ম্মের স্থাপক-রাক্ষসবংশ ধ্বংসকারী শ্রীরামচন্দ্র, অসুর দৈত্যদানব- ধ্বংসী শ্রীকৃষ্ণ।

হিন্দু ভগবানকে শুধু করুণাময় রূপে কল্পনা করে নি। তাঁকে ‘ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষণানাং’মহাকাল ও সংহারকারিণী মহাকালী রূপেও পূজা করেছেন। হিন্দুধর্ম্ম জীবন ও জগতকে অনিত্য ও মরীচিকা জ্ঞানে পরিত্যাগপূর্ব্বক কাপুরুষের মতো পলায়নের পরামর্শ দান করে নি। বরং আদেশ ও নির্দ্দেশ দিয়েছে-বিপদাপদে এমনকি মৃত্যুর ভয়েও ধর্ম্ম পরিত্যাগ করতে নেই। বর্তমানে ব্যক্তিগত ও জাতিগত জীবনে হিন্দু শক্তির সাধনা ও প্রয়োগে উদাসীন, তাই হিন্দু নির্জীব,নিপীড়িত। আজ পুনরায় শক্তির সাধনা, অনুশীলন ও আত্মরক্ষায় -স্বধর্ম্ম-স্বসমাজ- স্বজাতি  রক্ষায় উহার প্রয়োগের সঙ্কল্প হিন্দু হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে হবে।”

১ও২ নভেম্বর বিহার প্রদেশের অন্তর্গত মানভূম জেলায় হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। লক্ষণীয় এই সম্মেলনে অনেক সংখ্যায় সাঁওতাল, মুণ্ডা, বাউরী প্রকৃতি সকল জাতির সমাগম হয়েছিল। দুই দিনের এই হিন্দু সম্মেলনে বৈদিক যজ্ঞ, ভজন, কীর্তন, বক্তৃতা, লাঠিখেলা প্রদর্শিত হল। আচার্যদেব তাঁর ভাষণ উল্লেখ করলেন, হিন্দু সমাজ আজ দুর্বল কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাঁওতাল মুণ্ডা, বাউরী প্রভৃতি জাতি অহিন্দু বলে পরিগণিত হয় এবং ধর্মান্তরিত হয়। হিন্দু ধর্মের উদার ভাব ও আদর্শের দ্বারা এদেরকে হিন্দু সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলেন। ধর্ম,শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য তিনটি এদের যথেষ্ট পরিমাণে প্রয়োজন। আচার্যদেব আরো জানায় যে, প্রদেশে প্রদেশে সঙ্ঘের মিলন মন্দিরগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি প্রধানত এই কার্য করতে চেষ্টিত আছেন।

১৪ ও ১৫ নভেম্বর রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে খুলনা সেবাশ্রমে বার্ষিক হিন্দুসম্মেলন অনুষ্ঠিত হল।

এইভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু চেতনার আলোকে জাতি গঠন এবং ধর্ম সম্মেলন সমানভাবে চলতে থাকে। আচার্য প্রণবানন্দজী বলেন, “আমার এই আন্দোলন এই যুগের সর্বশেষ আন্দোলন।”

আচার্য প্রণবানন্দজীর যে হিন্দুসমাজ- সমন্বয়-আন্দোলন তার অনেকগুলি ফলশ্রুতির মধ্যে অন্যতম হল পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দুদের মাথা গুজবার একটা স্থান পাওয়া। কারণ ঐ সময় হিন্দুদের ঘোর দুর্দিনে আচার্যদেবের শুভ সঙ্কল্প এবং আশীর্বাদই হিন্দু জাতিকে রক্ষা করেছিল। (ক্রমশ)

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register