Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২৪১)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২৪১)

পর্ব - ২৪১

জ‍্যাঠামশায়ের সঙ্গে খেতে বসেছে খোকা। জ‍্যাঠামশায় বলছেন, খোকা, যখন খাবে, যত্ন করে খাবে। যেটুকু খাবে, শুধু সেটুকুই তুলে নেবে। চাষিরা খুব কষ্ট করে চাষ করে। ঠা ঠা রোদ্দুরে টোকা মাথায়  কোদাল দিয়ে মাটি কোপায়। আবার বৃষ্টির দিনে জল কাদার মধ‍্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করে।
জ‍্যাঠাইমা খাবার দিচ্ছিলেন। বললেন, গরিবের সম্বৎসর কষ্ট। ওদের কষ্ট ঘোচে না। ফসল ভাল হলেও মহাজনের দেনা শুধতে শুধতে সব শেষ। আবার দেনা।
হঠাৎ খোকা বলল, আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ‍্যমান।
জ‍্যাঠামশায় তার দিকে তাকালেন। এটা কোত্থেকে শিখলি?
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ওহো, তোমাকে তো বলাই হয় নি। লাইব্রেরিতে খুঁজে খুঁজে ও আজকাল কবিতার ব‌ই পড়ছে।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, ভাল। যা লেখা হয়, কবিতাই সবার সেরা।
জ‍্যাঠাইমা জ‍্যাঠামশায়কে জিজ্ঞাসা করলেন ভাপা ভেটকি রান্না কেমন হয়েছে?
তিনি বললেন, হুঁ।
আর পারশে মাছের ঝালটা?
তিনি বললেন, হুঁ।
স্বামীর নিস্পৃহতায় চটে উঠে তিনি বললেন, এই লোকটাকে নিয়ে আমার হয়েছে জ্বালা। খেতে দিয়ে মোটেও বোঝার উপায় নেই রান্না কেমন হয়েছে। আলোণা আঝালা খাবার দিলেও হুঁ, ঝাল বেশি দিলেও হুঁ।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, তোমার রান্না আজ কুড়ি বছর খাচ্ছি। নতুন করে আর কি বলব!
জ‍্যাঠাইমা রেগে উঠে বললেন, কুড়ি বছর খাচ্ছ বলে কি মুখে চড়া পড়ে গেছে? ভাল মন্দ কিছু তো বলতে পারো? পারো না? এত কষ্ট করে রান্না করি!
খোকা বলল, জ‍্যাঠাইমা, বাজে বোকো না তো! তুমি রান্না করলে কোথায়? সব তো বামুন মা রেঁধেছে। আর বাটনা বেটেছে কেলো পিসি। তুমি কি করেছ?
জ‍্যাঠাইমা জ‍্যাঠামশায়কে সাক্ষী মানলেন, দেখেছ, দেখেছ খোকা কতটা পাজি হয়েছে, বলে আমি কিনা কিছু করি না? দাঁড়া, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!
খোকা মাছ ভেঙে মুখে পুরতে পুরতে বলল, কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, বাঃ খোকা বাঃ। এমনি করে ব‌ই পড়তে হয়, আর পড়ে, সেই নিয়ে বলতে হয়। পড়া জিনিস বললে পরে আরো বেশি মনে থাকে।
আচ্ছা খোকা, মাছ তো খাচ্ছ, মাছ নিয়ে কোনো উপন্যাসের নাম বলতে পারো?
জ‍্যাঠামশায়কে ধমকে উঠলেন জ‍্যাঠাইমা। দাঁড়াও বাপু, মাছটা শান্তি করে খাচ্ছে, খেতে দাও। খাবার টেবিলে আর মা সরস্বতীকে ডাকাডাকি করে কাজ নেই।
কাঁটা ভাল করে বেছে, মাছ মুখে দিয়ে খোকা বলল, দি ওল্ড ম‍্যান অ্যাণ্ড দি সী। নোবেল পুরস্কার পাওয়া ব‌ই। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের। জেলেটার নাম স‍্যান্টিয়াগো।
জ‍্যাঠামশায় হেসে বললেন, আচ্ছা, মাছটার নাম যদি বলতে পারো, তো প্রাইজ পাবে।
খোকা শান্ত স্বরে বলল, মার্লিন মাছ।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, পড়ে তো অনেক। তবে বাবা কাছে না থাকলেই এ ব‌ই সে ব‌ই হাঁটকায়। তোমার মেডিক্যাল জার্ণালগুলো নিয়ে রোজ একবার করে টানাটানি। গুছিয়ে গুছিয়ে আমি আর পারি না।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, খোকা এখন তুমি ক্লাস নাইনে পড়ছ। তুমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়তে, সেই একষট্টি সালে হেমিংওয়ে মারা গেছেন। বড় কষ্টের মৃত‍্যু। মাথাটা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। আত্মহত্যা করে ফেলেন। নোবেল পেয়েছিলেন চুয়ান্ন সালে। তখন তুমি চার বছরের ছেলে। ওই বছরেই আমাদের কবি জীবনানন্দ‌ও মারা যান। ওই বছরেই সাহিত‍্য আকাদমি পেয়েছিলেন জীবনানন্দ। পঞ্চান্ন বছরেই জীবন শেষ।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ভাল লোকগুলোকে ভগবান নিজের কাছে টেনে নেন। দেখবে, ভাল লোক বেশিদিন বাঁচে না।
খোকা বলল, তোমার যত বোকা বোকা কথা। রবিঠাকুর আশি বছরে মারা গেল, গান্ধিজীও ওই রকম, বুদ্ধের‌ও আশি পেরিয়েছিল। এরা সব খারাপ লোক নাকি? ডাক্তারের ব‌উ হয়ে এত ফালতু কথা বলো কি করে?
দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাবা। চোখে আগুন ঝরছে। খোকা মুখ সামলে কথা বলো। মা জ‍্যাঠাইমার সাথে এভাবে কথা বলবে না।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, তুমি ছাড়ো তো ছোড়দা, মায়ে পোয়ে কথা হচ্ছে, তুমি এর মধ‍্যে নাক গলাও কেন? খোকা দ‌ই পেতেছি। টক দ‌ই। চিনি দেব না কিন্তু। খাবি তো?
বাবা বললেন, খাবে না মানে? আলবৎ খাবে।
জ‍্যাঠামশায় বাবাকে বললেন, তুই নিজের কাজে যা না বাপু। ওকে শান্তি করে খেতে দে।
বসার ঘরে একটা ডিভান। সেখানে পিঠে কয়েকটা বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন জ‍্যাঠামশায়।
খোকা বলল, জ‍্যেঠু, অনুদের বাড়িতে গেটে মার্বেল ফলকে একজনের নামের নিচে লেখা বার অ্যাট ল। ওর মানে কি?
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ওর মানে হল ব‍্যারিস্টার। খুব বড় ব‍্যাপার। তোকেও জজ ব‍্যারিস্টার হতে হবে।
খোকা বলল, কেন? আমি ব‍্যারিস্টার হতে যাব কেন?
জ‍্যাঠাইমা বললেন, কেন হবি না শুনি? লোকেরা স্বপ্ন দ‍্যাখে তাদের ছেলেপিলে জজ ব‍্যারিস্টার হবে।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, জানিস্ তো মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন ব‍্যারিস্টার।
খোকা বলল, আমি জজ বুঝি। বিচার করে। ব‍্যারিস্টার জিনিসটা কি আগে বলো?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, বিলেতে পাশ করা উকিল।
খোকা বলল, উকিল? ছোঃ, ও আমি কোনো দিন হব না।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, কেন রে, উকিল খারাপ কিসে? গান্ধিজী ওকালতি করতেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ করতেন।
জ‍্যাঠামশায় শুধরে দিয়ে বললেন, এঁরাও সব ব‍্যারিস্টার ছিলেন। নমস্য প্রাতঃস্মরণীয় ব‍্যক্তি।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাবা উকিল ছিলেন, কিন্তু তিনি ব‍্যারিস্টার হয়ে আসেন। তবে কবি মানুষ ছিলেন। পেশায় মন দিতে পারেননি।
খোকা বলল, কবি অনেক রকম হয় জ‍্যেঠু। ঈশ্বর গুপ্ত‌ও কবি ছিলেন। খালি বিদ‍্যাসাগরের পিছনে লাগতেন। খুব কুচুটে লোক ছিলেন। আর সজনীকান্ত দাস। নিন্দে করার ওস্তাদ।  নজরুলের নিন্দে করে নাম কিনেছেন।
জ‍্যাঠামশায় বলছেন, আমি প্রকৃত কবির কথা বলছি। মধুসূদন দত্ত ছিলেন উচ্চকোটির কবি। জজসাহেবদের খুব বকাবকি করতেন।
খোকা বলল, ব‍্যারিস্টাররা জজদের বকতে পারে?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, সব ব‍্যারিস্টার পারে না। মধুসূদন দত্ত উঁচু মানের কবি বলে পারতেন। সওয়াল করার সময়  তীব্র আবেগে ঝড়ের গতিতে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে কবিতা আউড়ে যেতেন, আর জজসাহেবরা বলতেন, মিঃ ডাট, আস্তে আস্তে রয়ে সয়ে বলুন, আমাদের তো কান দিয়ে শুনতে হয়! মাইকেল বলতেন, হ‍্যাঁ, বড়ো বড়ো কান তোদের, গাধার মতোন।
খোকা সন্দেহ প্রকাশ করে বলল, যাঃ, তুই করে বলতেন? কোর্টে অমন হয় নাকি?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, ইংরেজিতে তুই বলতেন।
খোকা বলল, ভারি মজা তো! ইংরেজি ভাষায় তো সব ইউ। তুই তুমি আপনি আছে না কি?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, জানো খোকা, বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন নামী সাহিত্যিক ব‍্যারিস্টার ছিলেন।
মা গানে বসেছেন। একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলেম নয়নজলে। গলাটা কাঁপছে। জ‍্যাঠাইমা বলছেন, অমন সুন্দর গলা। মোটে গানে বসবে না। রেওয়াজ না করলে হয়?
জ‍্যাঠামশায় জিজ্ঞাসা করলেন, এই গানটা কে লিখেছেন খোকা?
খোকা বলল, এটা একটা প্রশ্ন হল? সবাই জানে এটা অতুলপ্রসাদী। মায়ের খাতায় লেখা আছে।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, অতুলপ্রসাদ সেন। এলাহাবাদে থাকতেন। নামকরা ব‍্যারিস্টার।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ইনিও ব‍্যারিস্টার?
জ‍্যাঠামশায় হাসলেন। সবুজপত্র বের করতেন প্রমথ চৌধুরী। রবিঠাকুরের ভাইঝি জামাই। তিনিও ব‍্যারিস্টার ছিলেন। আর এস ওয়াজেদ আলী। সঙ্গে সঙ্গে খোকা বলল, সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, ওটা প্রবাদবাক‍্য হয়ে গেছে। একটা প্রবাদ বাক‍্যের জন্ম দেওয়া মানে একটা বিরাট ব‍্যাপার।
খোকা বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি থেকে ব‍্যারিস্টার হতে পাঠিয়েছিল। একবার মাদ্রাজ অবধি গিয়ে, যাওয়া ক‍্যানসেল করে, সেখান থেকে ফিরে এল। আরেকবার গেল, কিন্তু এটা সেটা করে আর পড়ল না। কিন্তু ভাগ‍্যিস পড়ল না। তবে না আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে পেলাম! জান জ‍্যেঠু, অনু বলেছে ও ওর বাবার দেখাদেখি আইন পড়বে। আমি বলেছি, আইন পড়া চলবে না।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, তুই তো আচ্ছা বাঁদর ছেলে! ওদের উকিলের গুষ্টি। ওর ওকালতি পড়াই তো ভাল! ধীর স্থির মেয়ে। পড়ে, মনে রেখে, পরীক্ষার খাতায় লিখে আসতে পারে। তোর মতো বিটকেল নয়।
খোকা জেদ ধরে বলল, আমি বারণ করেছি, ব‍্যাস্।
জ‍্যাঠাইমা বললেন,  না তুই কিচ্ছু বলবি না। কেন বলবি? যার যা ভাল লাগে পড়বে। তোর তাতে কি? তাছাড়া তোর চেয়ে ও বড়। ওকে তোর দিদি বলাই উচিত। এবার থেকে দিদি ডাকবি।
মুখ গোঁজ করে বসে র‌ইল খোকা।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, তুই তাহলে কি হতে চাস?
খোকা বলল, আমি কিছুই হব না। পথে পথে ঘুরে ঘুরে বেড়াব।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, বাঃ, কি উচ্চাশা ডাক্তারের ভাইপোর!
ইতিমধ্যে কাজের সহায়িকা ফল ছাড়িয়ে এনে খোকার সামনে দিয়ে গেল। সেই দেখে জ‍্যাঠাইমা বললেন, শোন্ তোকে একটা ঝাঁকা কিনে দেব। ফল নিয়ে বিক্রি করবি।
খোকা বলল, এই ফল বিক্রি করা পেশাটা মোটেও খারাপ নয়। জানো, বঙ্কিমচন্দ্র মানুষকে ফলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাউকে আম, আবার কাউকে ঝুনো নারকোল।
বাবা এসে দাঁড়ালেন। খোকা অঙ্কের টাস্ক কমপ্লিট?
খোকা হেসে বলল, হ‍্যাঁ বাবা, কমপ্লিট।
বাবা সরে যেতে জ‍্যাঠামশায় নিচুস্বরে বললেন, হ‍্যাঁ রে, সত‍্যি করেছিস? কখন করলি?
কাল সারারাত জেগে করেছি জ‍্যেঠু।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, সেকি, রাতে ঘুমাস্ নি?
জ‍্যাঠামশায় ইঙ্গিতে জ‍্যাঠাইমাকে সরে যেতে বললেন। খোকা, রাতে ঘুমোস নি কেন?
মুখ নিচু করে খোকা বলল, ঘুমের মধ্যে উদ্ভট সব স্বপ্ন আসে। বিছানা নষ্ট হয়। আমি বোধ হয় খারাপ হয়ে যাচ্ছি।
কাছে ডেকে পিঠে হাত বুলিয়ে জ‍্যাঠামশায় বললেন, ও রকম হয়। ওটা কিচ্ছু খারাপ নয়। সব্বার হয়। ওটা ন‍্যাচারাল।
জ‍্যেঠু, সত‍্যি বলছ?
হুঁ। আর স্বপ্ন নিয়ে একটা ব‌ই আছে আমাদের লাইব্রেরিতে।
খোকা বলল, জানি। সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, দি ইন্টারপ্রিটেশনস অফ ড্রিম। তুই ব‌ইপত্তর নাড়াচাড়া করছিস, এটা আমার খুব ভালো লাগছে। তবে দেখিস, গায়ে ধুলো না লাগে।
খোকা বলল, ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধূলাবালি, কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে ঘর্ম পড়ুক ঝরে।
মা গাইছেন, নিদ নাহি আঁখিপাতে। খোকা গলা মিলিয়ে দিল। জ‍্যাঠামশায় তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলেন।
ক্রমশ...
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register