Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোটগল্পে লিপিকা ঘোষ

maro news
ছোটগল্পে লিপিকা ঘোষ

ছোটুদা

আমাদের সময় ইলেভেন -টুয়েল্ভ কলেজে পড়ানো হত। আমি কলেজ হস্টেলে থাকতাম । সেখানে ছোটুদাও থাকত। হস্টেলে এসে শুনলাম ছোটুদা নাকি অনেকদিন ধরে হোস্টেলে আছে। প্রথম দিকে ইউনিয়নের দাদা ধরে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন সে নিজেই দাদা। ছোটুদা কোন ইয়ারে পড়ে কেউ জানে না। তবে জুনিয়ররা ওর খুব ফ্যান। বিপদে আপদে ছোটুদা সবার পাশে থাকে। ছোটুদা হোস্টেলের ঘরে কম থাকলেও যতক্ষণ থাকে জমিয়ে রাখে। একদিন রাত সাড়ে এগারোটার সময় ছোটুদা আমাদের ঘরে এল। আমদের হোস্টেলে “সাড়ে তিন তলা”বলে একটা ফ্লোরে আমরা ইলেভেন টুয়েল্ভ থাকতাম । এমনিতে ডিনারের পর কারও ঘরে যাওয়া নিষেধ । ছোটুদা এ নিয়ম মানে না । গানের লড়াই খেলবে বলল। পাশের ঘর থেকে পল্টু আর বাটুলকে ডেকে আনল। গানের লড়াই জমে উঠেছে এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। ছোটুদা বলল- সবাই আসছে! এবার আরও জমবে। আয়- আয় । কেউ এলো না। আবারও কড়া নাড়ার শব্দ হল । দরজাটা ভেজানো ছিল। ছোটুদা এবার বলল - আবে এ---এ-- আজা আজা.. । তাও কেউ এলনা। -কোন লাট সাহেব রে ? -বলতে বলতে ছোটুদা এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দেখল..হোস্টেলের সুপার দাঁড়িয়ে আছেন। ছোটুদার তখন ভূত দেখার মতো অবস্থা। সুপার বললেন-তুমি এ ঘরে কেন? -মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছি। ভোলার হাতে ব্যথা তাই। -তুমি কেন? রুম-মেটরা তো টাঙাতে পারত! -ওরা মন দিয়ে পড়ছে। মশারি টাঙাতে গেলে পড়ার ডিসটার্ব হবে তাই- হোস্টেলের সুপার আমাদের কলেজে ইতিহাস পড়ান। হোস্টেলেই থাকেন। রাশভারি লোক। আমার বেডে পল্টু বসেছিল,ওকে ইশারা করলাম খাটের নিচে লুকিয়ে পড়তে। ভোলার খাটে বাটুল বসেছিল,ওকে জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি তো ছাব্বিশ নম্বরের? তুমি এখানে কেন? । টেবিলের রাখা গুঁড়ো দুধের কৌট হাতে নিয়ে বলল- দুধমুড়ি খাবো তাই মুড়ি চাইতে এসেছিলাম। -দুধমুড়ি? -হ্যাঁ । আমূলের গুরো দুধ আর মুড়ি... -তুমি ডিনার করোনি? -হ্যাঁ তাও খিদে পেয়ে গেছে। ছোলার কাছে মুড়ি আছে তাই.. -ছোলা কে? -সুপ্রতিভ। ওর ডাকনাম ছোলা। ছোটুদা বলল-ভোলা, ছোলা আর ঝোলা এই ঘরে থাকে স্যার । স্যার আমাদের ডাকনাম জানতেন না। প্রচন্ড রেগে গিয়ে সবার গার্জেন কল করবে বলে চলে গেলেন। সবাই ভয়ে ভয়ে ছিলাম। বাবা কী বলবেন? সামনে পরীক্ষা। সব ছোটুদার জন্য হলো। কিন্তু তিনদিন পরেও গার্জেন এলো না । ভাবলাম স্যার আমাদের এ যাত্রা ক্ষমা করে দিয়েছেন। পরে জানলাম ঐদিন রাতে ছোটুদা সুপারের টেলিফোনের তার কেটে দিয়েছিল। তিনদিন ধরে সুপার ফোন ডেড পেয়েছেন,আর কলেজও বন্ধ ছিল তাই ফোন করতে পারেন নি। আর কিছুদিন পরে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। আমার রাত জেগে পড়ার অভ্যাস। কিন্তু হোস্টেলে রাত বারোটার পরে লাইট জ্বালতে দেয়না। আমার অসুবিধা হয়। একদিন ছোটুদা জানতে পেরে বলল -আগে বলবি তো?দাঁড়া দেখছি। এরপর একদিন রাত দেড়টা নাগাদ আমাদের ঘরে ছোটুদা এলো। করিডরের লাইট রাত বারোটার পর বন্ধ হয়ে যায়। দরজা খুলে দেখি অন্ধকারের মধ্যে হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি ধরে রোগা লিকলিকে লম্বাটে চেহারায় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে ছোটুদা। ভিতরে এসে বলল-শোন ছোলা,আমি যা বলব তাই করবি। তাহলে দেখবি কাল থেকে সারারাত হোস্টেলে আলো জ্বলবে। বলল- - প্রথমে তুই করিডোর দিয়ে ছুটবি ভূ---ত,ভূ—ত করে। তোর পিছন পিছন ভোলা আর ঝোলা যাবে। বলবি ভূত দেখেছিস। কী বলবি ঠিক করে নে। মনে রাখিস যা বলবি বার বার একই কথা বলবি। পাল্টে ফেলিস না। তাহলে ধরা পরে যাবি। আমি বললাম-পারব না ছোটুদা ! বলীর পাঁঠা আমাকে কেন করবে?ধরা পড়লে আমার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। আমাকে ছেড়ে দাও ছোটুদা । -তুমি তো মহাভারতের যুধিষ্ঠির!তুমি ছাড়া আর কারো কথা বিশ্বাস করবেন না তিনি। আমি কেঁদে ফেললাম। বললাম- আমার রাত জেগে পড়ার দরকার নেই। এবার আমাকে ছেড়ে দাও। ছোটুদা বলল- ঠিক আছে,তুই এক কাজ কর। তুই ফার্স্ট সিনটা করে অজ্ঞান হয়ে যা। যা বলার আমরা বলব। তবে এখন না,আমি ঘরে চলে যায় তারপর। ছোটুদা চলে গেল। কিছুক্ষন পর আমি ভোলা আর ঝোলা ঘর থেকে বেরিয়ে যথারীতি করিডোর দিয়ে ভূ ----ত ভূ----ত করে চেঁচিয়ে ছুটলাম। আমি কিছু দূর এসে “সাড়ে তিন তলা”র সিঁড়িতে অজ্ঞান হবার ভান করে পড়ে গেলাম। বাবা বাঁচলাম! সুপার কে মিথ্যে কথা আর বলতে হবে না। তিনতলার সবাই ছুটে এলো,পড়তে পড়তে,হোঁচট খেতে খেতে,ছুটে এলো। ভোলা বলল- -ও ভূত দেখেছে,আমরাও দেখেছি। ছোলার জানলার ওপাশে শুধু দুটো নীল রঙের চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। একতলা দোতলা থেকে দাদারাও ছুটে এলো...। ভূতের নাম শুনে কেউ ঘরে রইল না। দল বেঁধে আমাকে ঘিরে ধরল । হৈচৈ থামিয়ে ছোটুদা এলো-এত হৈচৈ করছিস কেন? কী হয়েছে? ঝোলা বলল-ছটুদা ছোলা ভূত দেখেছে ! -তাতে কী হয়েছে? অত ভয় পাবার কী আছে? আমি রোজ রাত তিনটের সময় ঘুঙুরের শব্দ শুনি। ছেলেরা আবার ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। হৈচৈ শুনে সুপার আলো জ্বেলে বেরিয়ে এলেন। উনি আমাকে ভালো ছেলে বলেই জানেন। উনি এসে আমাকে দেখে খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন -কীকরে হলো এসব? ছেলেরা সবাই মিলে বলল-ভূত দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে । -না না ভূত বলে কিছু নেই। অন্য কোনো ব্যাপার। ভোলা বলল-না স্যার আমরাও দেখেছি। -কী দেখেছ? -জানলার ওপারে শুধু দুটো চোখ। -বেড়ালের চোখ হবে নিশ্চয়ই । -বেড়াল ওখানে দাঁড়াবে কীকরে স্যার ? -যাই হোক সে পরে দেখা যাবে। এখন ওর চোখে মুখে জল দাও। ছোটুদা বলল-স্যার ওকে ঘরে নিয়ে যাই? সুপার রাজি হলেন। আমাদের ঘরটা বড় বলে ওখানে আমাকে শোয়ানো হল। ইলেভেনের নন্টু বলল-সেদিন মনে হয় আমিও তাহলে ভূত দেখেছি। ওকে আগে থেকে ছোটুদা শিখিয়ে রেখেছিল। ও বলল -বাগানের মধ্যে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে যাবার শব্দ পাচ্ছিলাম। কিন্তু তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। এটা বার বার হচ্ছিল জানেন স্যার? স্যার শুনে বললেন - ওটা মনের ভুল। ফার্স্ট ইয়ারের বল্টুদা বলল-না স্যার ছোটুদা রোজ রাতে কাকে যেন নাচতে দেখে। ছোটুদা বল্টুকে চোখ রাঙিয়ে বলল -তোকে বলতে বলেছি? বাটুল বলল -আজ কিছুক্ষণ আগে আমি নিজে করিডোরে সাদা কাপড়ে ঢাকা কাউকে মোমবাতি নিয়ে ঘুরতে দেখেছি । সুপার সায়েন্সের ছেলেদের বললেন-তোমরাও কি ভূতে বিশ্বাস করো ? মঙ্গলদা বলল-না স্যার ভূত টুত কিচ্ছু নেই। কিন্তু এরা যা করছে তাতে ভয়ে এদের হার্ট ফেল না হয়ে যায়! বীরুদা বলল-ব্যাপারটা আমিও বুঝতে পারছি না,তবে পরীক্ষার আগে এমন হলে তোরা পড়বি কি করে?বীরুদা থার্ড ইয়ারের সায়েন্সের ফার্স্ট বয়,পড়ার চিন্তা আগে আসে তার। স্যার দেখলেন ভয়ে ছেলেরা কেউ আর ঘরে একা যেতে চাইছে না। রাত তিনটে বেজে গেছে । দাদারা সাহস জোগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু জেগে ঘুমালে তাকে জাগাবে কে? কিছুতেই ওদের মনে সাহস জোগাতে পারল না। শেষমেশ স্যার বললেন-ঠিক আছে আজ কেউ একা ঘুমিও না। আর এক কাজ কর ভয় লাগলে রাতে ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারো। আমি রাতে করিডরের আলো জ্বালিয়ে রাখতে বলছি । আমার খুব আনন্দ হল। ভাবলাম কাজ শেষ হয়ে গেছে তাই উঠে বসে পড়লাম। স্যার সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশে বসে বললেন-শরীর ঠিক আছো তো? আমি ঘাবড়ে গিয়ে আবার অজ্ঞান এর ভান করে শুতে যাচ্ছিলাম। ছোটুদা দূর থেকে ইশারায় নিষেধ করল। ঝোলা বলল-তুই কী দেখেছিস স্যার কে বল? রাগে মনে হচ্ছিল ওর নাকে একটা ঘুষি মারি। বলব যদি তাহলে এতক্ষণ এত কষ্ট করে পড়ে থাকলাম কেন? স্যার বললেন -থাক থাক। আর ওসব মনে করতে হবে না। যারা ভয় পাচ্ছ তারা বড় রুম গুলোতে বেড জোড়া লাগিয়ে একসঙ্গে ঘুমাও। বলে স্যার চলে গেলেন। একে একে সবাই চলে গেল। সে দিনের পর থেকে হোস্টেলের করিডোরে সারারাত আলো জ্বলত । আমি রাত জেগে পড়তাম ,আমার দেখাদেখি অনেকেই আলো জ্বেলে রাত জেগে পড়ত। পরীক্ষা শুরুর আগের রাতে ঘুমাতে যাবো,এমন সময় ছোটুদা এল। ভোলা আর ঝোলা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোটুদার হাতের বই দেখে অবাক হলাম। এর আগে তিন জন আব্দার নিয়ে এসেছিল পড়া বুঝতে। এরা সারা বছর ঘুরে বেরাবে আর পরীক্ষা আগে আমার কাছে বুঝতে আসবে। কিন্তু ছোটুদার হাতে বই কেন? ছটুদা টুয়েল্ভের বাংলা সহায়িকা বইটা বাড়িয়ে বলল- একটু সিলেবাসটা দাগিয়ে দে না? -সিলেবাস? তুমি আমাদের সঙ্গে পরীক্ষা দেবে? -কাউকে বলিস না। অনেক বার চেষ্টা করে হয় নি। গতবছর নতুন করে ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিলাম । -কোন গুলো পড়তে হবে তাড়াতাড়ি দাগিয়ে দে,রাত জেগে পড়ে নেব। ছোটুদার মনের জোর দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এখনও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে! ছোটুদা আমার জন্য অনেক করেছে। আমি এটুকু করতে পারব না? বইটা নিয়ে ইম্পর্টেন্ট গুলো দাগিয়ে দিলাম ।বললাম পরের দিন থেকে একটু আগে এসে দাগিয়ে নিয়ে যেও,পড়ার সময় পাবে। পরীক্ষা শেষ হল। যথা সময়ে রেজাল্ট ও বের হল। ভোলা আর ঝোলা ফার্স্ট ডিভিশনে পেয়ছে। আমি কলেজে ফার্স্ট হয়েছি। চুপিচুপি বলে রাখি- ছোটুদা পাশ করেছে। ব্যর্থতা ছোটুদার কাছে হার মেনেছে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register