শ্যামলী বলল, ওটা একটা জন্মগত জিনঘটিত বিরল রোগ, যাতে বাচ্চার শরীর স্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে, কিন্তু বুদ্ধি গজায় না। বাচ্চার বয়স বাড়তে থাকলেও, তার বুদ্ধি শুদ্ধি থমকে রইল মোটে একবছরের শিশুর বুদ্ধির স্তরে।
অরিন্দম বললেন, আহা রে!
শ্যামলী বলল, সেরা সেরা ডাক্তারেরা পার্লকে জবাব দিলেন। মেয়ে কোলে নিয়ে দুনিয়ার সব ভালো ভালো ডাক্তারের কাছে ঘুরে ঘুরে একসময় পার্ল বুঝে গেল, এই অসুখের কোনোভাবেই কোনো রকম চিকিৎসা হয় না। জন্মের একান্ত সূচনাপর্বে জিনের কোনো একটা ত্রুটিপূর্ণ বিকাশ এই পরিস্থিতি ঘটিয়েছে।
মাকে দেখে মেয়ে খিলখিলিয়ে হাসে। একবছরের শিশুর অর্থহীন হাসি। শরীর বেড়ে উঠছে ফনফনিয়ে, অথচ বুদ্ধির দেখা নেই। মেয়ের হাসিখুশি চেহারা দেখে পার্লের বুক শুকিয়ে যায়। তাকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করে। ওর সমবয়সী অন্য বাচ্চারা স্কুলে যেতে শুরু করে দিয়েছে। মা বাচ্চাকে পড়াতে চান। বাচ্চা মাকে খুশি করবে বলে প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। হায় রে, তার মস্তিষ্কে সেই সুযোগটাই যে নেই। বাচ্চার বৌদ্ধিক উন্নতির কোনো রকম সম্ভাবনা নেই টের পেয়ে, বাচ্চার বাবা তার উপর আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেন। তখন পার্লের বুকে চিন্তার পাষাণ চেপে বসল, আমি যদ্দিন, তদ্দিন নয় আমি সামলে দেব। তারপর কি হবে? এই যে অনিন্দ্যকান্তি শরীরের অধিকারিণী এ মেয়ে, এ যে সহজেই পুরুষের লালসাভরা দৃষ্টি ও স্পর্শের শিকার হবে, অথচ কিছুতেই কিছু বুঝতে পারবে না।
বাচ্চা কি করে বাঁচবে, সেই হয়ে উঠল পার্লের ধ্যানজ্ঞান। সে তখন আর ডাক্তার খোঁজে না। খোঁজে সেইসব আবাস যেখানে এ ধরনের সমস্যা বিজড়িত মানুষেরা থাকে। সেইসব জায়গার খোঁজ নিতে গিয়ে সভ্যতার একটা গাঢ় কলঙ্ক দেখে ফেলল পার্ল। প্রায় সর্বত্র মানসিক সমস্যা আর পাগলামিকে এক করে দেখা হয়। টাকা কবুল করেও পর্যাপ্ত ভদ্র সভ্য পরিবেশ প্রায় কোথাও নেই।
এদিকে স্বামী নিজের কাজে বেশি বেশি করে ডুব দিলেন। দিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়ে দেন অধ্যয়ন অধ্যাপনায়।
পার্লের কোলে যে জন্মেছে, সে যে তাঁরও সন্তান, এই সহজ সত্যকে স্বামী ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেন। ক্রমে তিনি পার্লের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিঁড়ে দিলেন।
সবিতা বললেন, আহা রে!
শ্যামলী বলল, বাবা দ্যাখো, মা বাচ্চার জন্ম দেন ঠিকই, কিন্তু বাবার ভূমিকা কিন্তু কম নয়। "যদিদং হৃদয়ং তব" বলে বিয়ে করে তারপর কোনো কারণে কোনো ভাগ্য বিপর্যয় এলে, সেটা দুজনের সমহারে ভাগ করে বহন করা উচিত। পার্লের ক্ষেত্রে তা হয় নি। চা খেয়ে যেমন ভাঁড় ফেলে দিতে রোয়াকের চা পিপাসুর বাধে না, তেমনি করে পার্লের কৃষিবিজ্ঞানী বর তাকে এঁটো ভাঁড়ের মতোই ছুঁড়ে ফেলে দিল। বেশ্যাখানায় যে যায়, সে নিজের জৈবিক চাহিদাটুকু মেটাতেই যায়। যৌনতা কিনতে চায়। যে মেয়ে তাকে দেহ দিচ্ছে, সেও যে একটা মানুষ, তার যে মন মেজাজ মর্জি বলে কোনো কিছু থাকতে পারে, সেটা কেউ ভাবেই না।
শশাঙ্ক অধৈর্য হয়ে বললেন, সে তো আমরা জানি। প্রস কোয়ার্টারে মানুষ নারীমাংস কিনতে যায়। কিন্তু তা বলে তুই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে ওই পর্যায়ে নামাতে পারিস না।
শ্যামলী বলল, বাবা, তাহলে তোমাকে পরশুরামের বাপ মায়ের গল্পটা শোনাতে হয়। পরশুরাম এর মা ছিলেন রেণুকা। রেণুকার স্বামী ছিলেন জমদগ্নি নামে এক ঋষি। ঋষি হলে কি হবে, জমদগ্নির ছিল ক্ষত্রিয় স্বভাব। তিনি তীর ছোঁড়া প্র্যাকটিশ করেন। গ্রীষ্মের খররৌদ্র ঝলসানো দিনে জমদগ্নি একেরপর এক তীর ছুঁড়ে চলছেন। আর রেণুকার উপর ভার সেই তীর কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনা।
সকাল থেকেই নাওয়া খাওয়া ভুলে ঘর্মাক্ত কলেবরে জমদগ্নি তীর ছুঁড়ে চলেছিলেন, আর রেণুকা, ঋষিপত্নী খররৌদ্র মাথায় নিয়ে তা কুড়িয়ে এনে দিচ্ছেন।
সকাল থেকেই এই চলছে। একসময় ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন রেণুকা মাটিতে পড়ে গেলেন। ছুটে এলেন জমদগ্নি। কী হল তোমার?
রেণুকা উত্তর করলেন, প্রভু, এই রৌদ্রের তাপে আমি মারাত্মক ক্লান্ত বোধ করছি। তাঁর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটায় জমদগ্নি সূর্যের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দিকে জ্যাকর্ষণ করতে উদ্যত হলেন। কোপনস্বভাব মুনির চণ্ডাল রাগের থেকে বাঁচতে সূর্য এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে একসেট ছাতা আর জুতো উপহার আনলেন। জমদগ্নি ওসব কোনোদিন দেখেন নি। তিনি ছাতা আর জুতো কি করে ব্যবহার করতে হয় জানেন না। সূর্য তাঁকে ছাতা ও জুতার ব্যবহার শেখালেন।
শশাঙ্ক বললেন, এ তো স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়বদ্ধতার গল্প!
শ্যামলী বলল, হুঁ, কিন্তু যখন সরোবরে স্নান করতে গিয়ে রেণুকা দেখল মার্তিকাবর্ত দেশের রাজা নিজের স্ত্রীদের সাথে জলবিহার করছেন, অমনি রেণুকার ইচ্ছে হল, তাঁকেও কেউ স্পর্শ আদর চুম্বন লেহন করুন। কামপিপাসায় রেণুকা রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলেন।
কামতাড়িত রেণুকার অবস্থা জানতে পেরে জমদগ্নি সাংঘাতিক রেগে গেলেন। তিনি রেণুকার এই কামার্তিকে রীতিমতো অপরাধ হিসেবে গণ্য করে, পুত্রদের নির্দেশ দিলেন মায়ের মস্তক ছিন্ন করো। পরশুরাম পিতৃআজ্ঞায়, মাতৃ মস্তক ছেদন করলেন।
শশাঙ্ক বললেন, সে তো তারপর প্রাণ ফিরে পেয়েছিল?
শ্যামলী ম্লান হেসে বলল, বাবা, তুমি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করো, কচাং করে মুণ্ডু খসিয়ে দেবার পর, তা আবার জুড়ে দেওয়া যায়?
শশাঙ্ক চুপ করে যান।
শ্যামলী বলল, বাবা, এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একরাত্রি গল্পটা মনে পড়ে গেল। যেদিন রান্না ভাল হত, সেদিন সুরঞ্জনার বর কী খুশি। সোনার গহনা গড়াতে দিতেন। আর যেদিন দুধে ধোঁয়া গন্ধ হত তখন বউকে গালমন্দ করতেন। এদেশে বিদেশে বেশিরভাগ পুরুষ মনে করে সে একটা মেয়েকে বিয়ে করে তার উপকার করে। কিসে বউ খুশি হবে, কি ভাবে তার যৌনতৃপ্তি হবে, তার সুব্যবস্থা করা বেশিরভাগ মানুষ নিজের দায়িত্ব বলে ভাবতেই পারে না।
সাধারণতঃ স্বামীর ঘরে বউ প্রেয়সী সখী সচিব ললিতকলাবিধির উৎসাহদাত্রী নন, অন্ধ কামনা একতরফাভাবে মেটানোর যন্ত্র। যৌনসংযোগের সময়ে স্ত্রীরও যে সমানভাবে তৃপ্তি পাবার অধিকার আছে, তা পুরুষদের ভাবতে বয়ে গিয়েছে! অর্গাজম কথাটা কেউ কান পেতে শোনেই নি!
বৌকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা যায়, ইচ্ছে করলেই এঁটো ভাঁড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায়। তাই আমার মনে হয়েছে বিয়ে জিনিসটা একটা লিগালাইজড বেশ্যাবৃত্তি।
0 Comments.