Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || সৌরভ সন্ধ্যায় || লিখেছেন কৌশিক চক্রবর্ত্তী

maro news
T3 || সৌরভ সন্ধ্যায় || লিখেছেন কৌশিক চক্রবর্ত্তী

ফিরে দেখা - কবি সৌরভ চন্দ্রের সাথে

অনেকটা শূন্যতার মধ্যে পরিপাটি করে সাজানো থাকে ঘিয়ের প্রদীপ। তার শিখার আগুনে ঝলসে যায় অপর্যাপ্ত শূন্যস্থান। এটাই নিয়ম। আগুনের অস্তিত্ব চিরকালই টের পেয়েছে অন্ধকার ঘর। আর সেই অন্ধকার ঘরে আলো ফিরেছে নিয়ম করেই। আজও ফেরে। হঠাৎ মহামারীর কোপে হারিয়ে গেল এরকমই একটুকরো আগুন রঙের ঢেউ। যাঁর অস্তিত্বই চিনিয়ে দিতো তাঁর স্বকীয়তাকে। সৌরভ মুখার্জি। পেন নেম সৌরভ চন্দ্র। কলকাতা তথা বাংলার তরুণ কবিসমাজ যাঁকে এই অগ্নিবলয়েরই নেতৃত্বের ভার দিয়েছিল নির্দ্বিধায়। সৌরভ দা আজ আর নেই। নেই সেই কবিতাকে ঘিরে প্রচণ্ড উল্লাস, অন্যায়ের বিরোধিতা করবার তীব্র তাগিদ। হয়ত ছেড়ে থাকবার নামই জীবন। প্রদীপকে নিভিয়ে দেবার মুহূর্তই দস্তুর। কিন্তু সৌরভ দা রা নেভেন না। তাঁরা দ্বিগুণ উৎসাহে ফিরে আসেন কাজের কাছাকাছি। মনে পড়ছে প্রথম দেখা হবার দিনটা। অরিজিৎ (কবি অরিজিৎ বাগচী) ফোন করে বললো, কয়েকদিনের মধ্যেই তোমায় ফোন করবে সৌরভ দা, অর্থাৎ ঘাসের আড্ডার সম্পাদক ও বলিষ্ঠ সংগঠক সৌরভ মুখার্জি। আমার মতো একজন স্বল্পভাষী, লাজুক মানুষের কাছে এ সত্যিই অবাক হবার মতো বিষয়। সৌরভ দার কবিতা নেতৃত্ব তখন সুবিদিত। সমস্ত কবিদের একটা ছাতার তলায় আনা আশু প্রয়োজন, এ তাগিদ তাঁর স্বতপ্রণোদিত। আমায় তার ছোট একটি অংশ করে নেবার জন্য ফোনও এলো সৌরভ দার। ওপারে একজন চল্লিশের দামাল যুবক। আর আমি তাঁর প্রতিবাদী শব্দগুলো একনাগাড়ে শুনতে থাকা এক মহাস্থবির মাত্র। কবিতাকে নিঃসংকোচে প্রতিচ্ছবি করে নেওয়া যায় কিন্তু পণ্য করা যায় না। কবিতা কবির অহংকার, কিন্তু ক্ষমতায়ন নয়। এই আপ্তবাক্যগুলোর সাথে জড়িয়ে যেত কবি সৌরভ চন্দ্রের শব্দগুলো। তাঁর ডাকে আর সর্বোপরি নিজেকে নিজের কাছে করা প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে ঠিক বারবার পৌঁছেও যেতাম নন্দন নামক ধর্মস্থানটার চৌকাঠে। ঘুরতাম ফিরতাম, সঙ্গী হত সেই সৌরভ দাই। তারসাথে আজকের অর্থাৎ শূন্য দশকের পরে সাহিত্য জগতে শব্দবাজির একগুচ্ছ কারিগররা। কিন্তু সকলেই ভিড় করে ওই যাদুকরকে ঘিরে। মনে পড়ছে একটা দিনের কথা। নন্দন চত্ত্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সরকারি লিটিল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসব। স্বভাবতই কর্মক্ষেত্রের পরে পৌঁছে গেছি সেখানে। প্রথমেই ছুটে গেলাম জীবনানন্দ সভাঘরের উদ্দেশ্যে। বই ঘাঁটা তো হবেই। কিন্তু তরুণ কবিদের মুখে কবিতাপাঠ শোনার সুযোগ হাতছাড়া করার স্পর্ধা আমার অন্তত হয় নি সেদিন। যথারীতি দেখা সৌরভ দার সঙ্গেই। "এসো কৌশিক দা, এই সোফায় বসো"। শাসকদলের একজন সর্বক্ষণের কর্মী হয়েও তাঁর বক্তব্যের নিরপেক্ষতা বরাবরই মুগ্ধ করতো। কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখি এই 'কৌশিক দা' ডাকটা আমি হাজার চেষ্টা করেও শেষদিন অবধি বন্ধ করতে পারি নি মানুষটার মুখে। বারেবারে বলেছি, বয়সের অঙ্কে তুমিই দাদা গো। কিন্তু কবে আর কার কথা শুনেছে এই আগুন রঙের ঢেউগুলো। তারা নিজের খেয়ালেই চিরকাল আছড়ে পড়েছে নীরব সৈকতে। সৌরভ দাও শোনে নি কোনোদিনই। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। বাংলা আকাদেমির সামনে ভি আই পি দের জন্য বরাদ্দ সুসজ্জিত সোফায় বসে পড়ব সেই ঔদ্ধত্য আমার যে এককথায় হবে না তা যাঁরা আমায় চেনেন তাঁরা বিলক্ষণ জানবেন। স্বভাবতই সৌরভ দাকে বলে বসলাম - এখানে আমি বসব না দাদা। আমি বরং ভেতরে যাই। কিন্তু বিপরীতের মানুষটা যে প্রতিবাদী। তাঁর প্রত্যেকটি প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে আছড়ে পড়েছে বারবার শহরের সৈকতে। সেবারেও তাই। বলে উঠলেন - "এই জায়গা এখন তোমার মত এই প্রজন্মের লেখকদেরই কৌশিক দা। তোমরা না বসলে আর কে বসবে? বোসো বোসো।" কথাটা আজও ভুলিনি। মনে পড়ছে বারবার। হয়ত স্বীকৃতি বলে আসে না কোনোদিনই। কিন্তু সেদিনের ওই শব্দবন্ধ আমায় অনেকটা চিনিয়ে দিয়েছিল সংগঠক সৌরভ মুখার্জিকে। সেদিন সোফায় বসে কফির কাপে অনেকক্ষণ ঢেউ উঠেছিল শাব্দিক অনুরণনের। তারপর প্রেক্ষাগৃহে কবিতা পাঠ। কবিতা পড়লো সৌরভ দাও। আজ খুব মনে পড়ছে সেই কবিতাটা। 'আহা ট্যাক্সি, ওহো ট্যাক্সি'। যাঁরা সৌরভ দার কাছাকাছি থাকতেন তাঁরা প্রত্যেকেই এই শব্দভেদী বাণটির তীক্ষ্ণতা জানেন। তাঁর শব্দনিক্ষেপে এফোঁড়ওফোঁড় হয়েছে শরীর। আমিও গুণমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম। বারেবারে শূন্যতাকে ছুঁয়ে দেখেছে অগুনতি শ্রোতারা। প্রতিদিনই একটু একটু করে যেন কাছে গেছি এই মানুষটার। চিনেছি খুব সামনে থেকে। দেখেছি একটি তরুণ লেখনীর জন্য অনায়াসে কত বজ্রপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে। ব্যক্তিগত সম্পর্কে মতান্তর একটি সম্পর্কের সংজ্ঞা চিনিয়ে । ঠিক তেমনই সৌরভ দার প্রত্যেকটি কাজে ও সিদ্ধান্তে যে আদ্যোপান্ত শিলমোহর দিয়ে এসেছি বরাবর তাও নয়। বিভিন্ন বিষয়ে দুজনে মতামত বিনিময় করেছি খোলামনে, আবার কখনো হয়ত বিরোধিতাও করেছি উভয়তই দায়বদ্ধতার তাগিদ থেকেই। কিন্তু মনান্তর হয়নি একদিনের জন্যও। এরকমই কত কত স্মৃতি আর ধীরে ধীরে সম্পর্কের উষ্ণতা আহরণ। আর এভাবেই কখন যেন কবিতার আলোপথ বেয়ে জীবনের সঙ্গে মিশে গেছিল কবি সৌরভ মুখার্জি, সংগঠক সৌরভ মুখার্জি, সম্পাদক সৌরভ মুখার্জি, প্রতিবাদী সৌরভ মুখার্জি এবং তদুপরি বন্ধু সৌরভ মুখার্জি। সকলেই একটি রক্তমাংসের মানুষ। কিন্তু তার মধ্যেই কত স্তর, কত অনুভব। সেই সৌরভ মুখার্জি আর নেই। নেই তাঁর দৃপ্ত পদচারণ। আর কখনো বলতে হবে না - 'দাদা বোলো না সৌরভ দা, নাম ধরে ডাকো'। কিন্তু আনাচেকানাচে রয়ে গেছে সেই চিরস্থায়ী পায়ের ছাপটুকু। আজও তাঁর অকাল বিদায়ে ভার্চুয়াল মাধ্যম উত্তাল৷ কোভিটের করাল গ্রাস অহরহ কেড়ে নিচ্ছে টাটকা প্রাণ। তাঁর দাবী বড় কঠোর৷ তাঁর গ্রাস অন্ধকূপের মতো৷ সেই নিঃসহায় অন্ধকূপের অন্তরালে মিশে গেল সমস্ত দৃপ্ত উচ্চারণ। আজ বড় কঠিন সময়ে হাজির হয়েছি আমরা। 'অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো'তে আবার ঘুরে দাঁড়াবে পৃথিবী। জানি আবার সমস্ত বসন্তের পলাশে ঢেকে যাবে পথ। কিন্তু নন্দনের চৌহদ্দিতে আর কেউ হয়ত চিৎকার করে বলে উঠবে না - 'রাজা তোর কাপড় কোথায়'।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register